সোনা-দানা নয়, রুপো-তামার পাত্র না, মোবাইল-ট্যাবলেট-ল্যাপটপ, সাইকেল-বাইসাইকেল, মানিব্যাগ নয়। বই! লাইব্রেরির বই। চুরি করেছে এক কিশোর। পাঠকহীন স্পর্শকাতর বইয়ের পাতাগুলিকে বিক্রি করে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রটি কতটুকু পাপ করেছে তাহলে?
নীতির প্রশ্ন তুলে রেখে বাঙালির বইপ্রীতির সূত্রটি তলিয়ে দেখলেন সম্বিত বসু।
অলংকরণ, সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়, পড়ে শোনালেন চৈতালী বক্শি।
চুরি হয়েছে। জব্বর চুরি!
তবু কেউ হায় ‘আমার সর্বস্ব গেল রে’ বলে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েনি। হাহাকার করেনি। সোনা-দানা নয়, রুপো-তামার পাত্র না, মোবাইল-ট্যাবলেট-ল্যাপটপ, সাইকেল-বাইসাইকেল, মানিব্যাগ নয়। বই! লাইব্রেরির বই। চুরি করেছে এক কিশোর। ২২-২৩ বস্তা বই চুরি করে, সেই বইগুলোকে বিক্রি করে দিয়েছে কাগজ বিক্রেতার কাছে। পেয়েছে ৩৫০০ টাকা। তা দিয়ে পুজোর সময় দিব্যি খেয়ে-দেয়েছে, মৌজ-মস্তি করেছে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে– সাইকেলে করে সেই অষ্টম শ্রেণির ছাত্রটি দীর্ঘকালই আসছে-যাচ্ছে বই নিয়ে। তার প্রতি কারও নজর পড়েনি, সন্দেহ হয়নি।
নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নটিকে আপাতত সরিয়ে রাখছি। নীতিশিক্ষা সে স্কুলে পাবে, পাড়াপড়শি, স্বগৃহে পাবে। কিন্তু এইবেলা যা বলার, ছেলেটিকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ এই কারণে যে, বইকে সে ‘পণ্য’ বলে মনে করেছে। ক্লাস এইটের কিশোরের এই মন বড় হতে হতে যদিও পাল্টে যাবে! সাধারণের চোখে, ডাহা সংস্কৃতিবাজদের চোখে, বই বড় মহান শিল্প। আর কে না জানে, শিল্প করলে টাকাপয়সা উপার্জন খুব ঝক্কির! কলেজ স্ট্রিট বাজারে লেখকদের সম্মানদক্ষিণা, প্রচ্ছদশিল্পীদের উপার্জন, হরফ বিন্যাসকারীদের রুজি-রোজগার, বাঁধাইশিল্পীদের দুরবস্থা দেখলেই বোঝা যায়– বই শুধুই এক নরমসরম উদাসীন শিল্পসামগ্রী। তাকে বাকি পণ্যের সঙ্গে এক তালিকায় রাখা যায় না। চাল, ডাল, মাছ, ফুলকপি ও রবীন্দ্র রচনাবলী কি এক হতে পারে? পারে। একটা শরীরের খাবার, আরেকটা মনের। পণ্য বলে মনে করলে, তবেই তার একটা মানসম্মান বাড়ে। অর্থের ব্যাপারখানা বাদ দিয়ে দিলেই এ বাংলায় শিল্প দুরন্ত হয়ে ওঠে। যে লেখক ছিন্নবস্ত্র পরবেন, যে কবির দেহে ধরা পড়বে তীব্র অসুখ, যে শিল্পীর দৈন্য চোখে দেখা যাবে না– তাঁরাই আজ এক সাংস্কৃতিক সূত্র মতে, ‘মহৎ’ তকমা পাবেন। এমন হতেই পারে তাঁরা মহাকালের চেয়ারটিতে গিয়ে বসবেন, কিন্তু তার একমাত্র ছল এই অর্থ-হীনতা নয়। তাকে যেনতেন প্রকারেণ হতে হবে প্রতিভাবান। এই তো একমাত্র শর্ত। একজন সুস্থসবল, ঝকমকে লোকও কবি– যদি তিনি লিখতে পারেন সুদূরপ্রসারী দু’চার পঙ্ক্তি। রক্তের অন্তর্গত সফলতা-নিষ্ফলতা থাকতে পারে, কিন্তু বাইরের ওই মোহ-আবরণ দিয়ে তাঁকে সাহিত্যের দাঁড়িপাল্লায় মাপব কেন?
বই নিয়ে বাঙালির সংবেদনশীলতা যথেষ্টই ছিল। ইদানীং, তা তলিয়ে গিয়েছে হয়তো বা। একের পর এক কবি-লেখক-পাঠকের মৃত্যুর পর তাঁর সারাজীবনের সংগ্রহের যাবতীয় বই এসে পড়ে নানা ফুটপাথে– পুরনো বইয়ের ভিড়ে। আগ্রহের ভাগবাঁটোয়ারা হয়। সে ভালোই ব্যাপার। কিন্তু সারাজীবনের ওই বই আগলে রাখা মানুষটি কি কখনও তাঁর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের এই ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পেরেছিলেন? শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে তাঁর বইয়ের বিপুল সংগ্রহকে গ্রন্থাগারের রূপ দিচ্ছেন, সেরকম কোনও ব্যবস্থা হয়তো সকলে করে উঠতে পারেন না। কিন্তু এক সর্বগ্রাসী পাঠকের মৃত্যুর পর উত্তরপুরুষ বা উত্তরনারী কেন বইকেই বাতিল-জঞ্জাল বলে মনে করবে? পাঠকের উত্তরাধিকার যে রক্তের সম্পর্কেই ঘটতে থাকবে, তা নয়। কিন্তু এই বইতাড়ানো পদ্ধতিটি কি কাম্য? কেন গ্রন্থাগারের পক্ষ থেকে আসবে না এই প্রস্তাব, এমনকী, এই প্রস্তাব উল্টোদিক থেকেও তো যেতে পারে– কিন্তু সে বড় স্বপ্নকল্পনা।
ছেলেটিকে আবারও ধন্যবাদ, কারণ, বই যে গ্রন্থাগারের কাছে মোটেই মহার্ঘ নয়, তা প্রমাণ করে দিয়েছে সে। নইলে ২২-২৩ বস্তা পুরনো বই কেউ নিরুপদ্রবে গাপ করে দিতে পারে? আবারও বলি, খবর বলছে, অনেক দিন ধরেই এই কাণ্ড ঘটেছে। ফলে বইয়ের প্রতি এই যে প্রাতিষ্ঠানিক হেলাফেলা, তার পেটে গুঁতো মারার জবরদস্ত প্রক্রিয়া হিসেবে এটাকে দেখব না কেন? একটা লড়ঝড়ে, তামাদি ব্যবস্থাকে এ এক অচিন্তনীয় ল্যাং!
‘‘অধিকাংশ লাইব্রেরিই সংগ্রহবাতিকগ্রস্ত। তার বারো আনা বই প্রায়ই ব্যবহারে লাগে না, ব্যবহারযোগ্য অন্য চার আনা বইকে এই অতিস্ফীত গ্রন্থপুঞ্জ কোণঠাসা ক’রে রাখে।… বড়ো লাইব্রেরির গর্ব অনেকখানিই তার গ্রন্থসংখ্যার উপরে। সেই গ্রন্থগুলিকে ব্যবহারের সুযোগদানের উপরেই তার গৌরব প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আপন অহংকার-তৃপ্তির জন্যে সেটা অত্যাবশ্যক নয়।’’ – এই কথাগুলো রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ১৯২৮ সালে, নিখিল ভারত গ্রন্থাগার সম্মিলনে। সেই সভায় তিনি ছিলেন অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি। প্রায় ১০০ বছর আগের সেই কথাগুলো আজকের পশ্চিমবঙ্গীয় গ্রন্থাগারের ক্ষেত্রে কী অবিকলভাবে খেটে যায়! যদিও ১৯৭৯ সাল নাগাদ আমাদের গ্রন্থাগার আইন হয়েছে। গ্রন্থাগার পরিষেবা দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, পশ্চিমবঙ্গে ২৪৮০টি গ্রন্থাগারও রয়েছে, যার মধ্যে ১৩টি সরকারি গ্রন্থাগার। কিন্তু তাদের হালহকিকত কী, ‘পাবলিক’ জানে? দফতরের সাইটে এক প্রকল্পের উল্লেখ করা, অপূর্ব বানান ভুল-সহ: ‘বোই ধরো বোই পরো প্রকল্প’। এ-ও ‘বোই’য়ের প্রতি আমাদের তৃষ্ণার প্রকাশই বটে!
যদি পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনের ওই সরকার পোষিত গ্রন্থাগারটি এহেন রবীন্দ্র-উক্তির সামনে বিপন্ন বোধ না করে, যদি ধরে নেওয়া যায় যে, গ্রন্থাগারটি বইয়ের চাঁই নিয়ে আত্ম-অহংকারে পুষ্ট নয়, তবুও গ্রন্থাগারিকের বক্তব্যটি স্মরণীয়: ‘বইগুলি গ্রন্থাগারে আসুক আর পাঠক বাড়ুক। একেবারেই তলানিতে পাঠক সংখ্যা। বহু পুরনো বই পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে।’
এই পাঠকহীন স্পর্শকাতর বইয়ের পাতাগুলিকে বিক্রি করে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রটি কতটুকু পাপ করেছে তাহলে? কতকালের অন্ধকার থেকে মুক্তি পেয়ে সে বইগুলো কিঞ্চিৎ আলো দেখেছে। মোটামুটি সমস্ত বই-ই পুনরুদ্ধার করা গিয়েছে– সে ভালো কথা। তারা পুরনো তাকে নতুন করে ঠাঁই পাক। তাকের যত্ন নিন ভাইসব।
পাঠক, সেইসব তাকে বইয়ের পাতা উল্টোলে বোঝা যাবে, শুধু আমি নই, সেই ২২-২৩ বস্তা বই-ও ধন্যবাদ দিচ্ছে। পাঠককে তো বটেই। ওই অষ্টম শ্রেণির ছেলেটিকেও।