বাইশে শ্রাবণ। এই দিনই চলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই উপলক্ষে ফিরে দেখা কবির জীবনের শেষ দিনগুলি। ছুঁয়ে থাকা বাইশে শ্রাবণ-কে।
পাঠ – দেবশঙ্কর হালদার
শব্দগ্রহণ ও আবহ – শঙ্খ বিশ্বাস
পরিকল্পনা – Team সংবাদ প্রতিদিন শোনো
প্রায় একবছর হতে চলল কবির শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না। এর আগে তিনি বেশ জোর দিয়েই বলতেন, আর সকলের শরীর আর রবীন্দ্রনাথের শরীর এক নয়। কিন্তু এখন আর যেন সে কথাটা ততটা জোরের সঙ্গে বলতে পারেন না। ১৯৩৭-এ একবার সংকটে পড়েছিলেন। জ্ঞান হারিয়েছিলেন। তবে সামলেও নিয়েছিলেন। এরপর ১৯৪০-এ ফের শরীর জানান দিতে শুরু করল অসহায়তা। শান্তিনিকেতনে সেবার বিরাট উৎসবের আয়োজন। কবিকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে দেওয়া হবে ডক্টর উপাধি। তখনই অল্পস্বল্প জ্বর হচ্ছে কবির। সকলেই সে নিয়ে বেশ চিন্তিত। অনেকেই বারণ করলেন। বললেন, এই বয়সে কবির এত ধকল না নেওয়াই ভালো। কিন্তু কবি আশ্রমের জন্য নির্দিষ্ট কাজ করবেনই। কেউই তাঁকে নিরস্ত করতে পারেন না। আশ্রমের এই কাজটিকে তিনি অন্তর থেকে ভালোবাসেন। যদিও শরীরের হাল ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। যে কবি সারাক্ষণ কাজে ডুবে থাকতে ভালোবাসেন, তিনিও যেন আর মন বসাতে পারছেন না কোনও কিছুতে। সবকিছুতেই যেন বেশ অরুচি। শান্তিনিকেতনে থাকলেও নানা বাধানিষেধ। এদিকে কলকাতায় এলেও ডাক্তাররা হাজারকম বারণে বেঁধে রাখেন। পদে পদে এমন হাজারও ছোট ছোট নিষেধের ডোরে বাঁধা পড়তে পড়তে কবি যেন ক্রমশ হাঁফিয়ে উঠেছেন। প্রিয়জনকে চিঠিতে জানাচ্ছেনও সে কথা। লিখছেন, শরীর ক্রমশ ভেঙে পড়ছে। দিনগুলো বহন করা যেন অসাধ্য হয়ে উঠছে। যদিও অপারেশনে তাঁর মোটেও সায় নেই। যে কেউ এ বিষয়ে কিছু বলতে আসেন, কবি তাঁর অসম্মতি জানিয়ে দেন। শেষবেলায় শরীরে কোনরকম অস্ত্রাঘাত হোক, এ তিনি কিছুতেই চাননি। অথচ শরীর, মন – সবকিছু জুড়েই যেন নেমেছেন অপরিসীম ক্লান্তি। শেষমেশ কবি চললেন কালিম্পিং। সেখানে তখন ছিলেন কবির পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। যদিও ডাক্তারদের বারণ ছিল, তবু চললেন। আর কালিম্পিং গিয়েই ফের অসুস্থ হয়ে পড়লেন কবি। জ্ঞান হারালেন ২৭ সেপ্টেম্বর। সে যাত্রায় একটু সুস্থ হতেই কবিকে ফিরিয়ে আনা হল জোড়াসাঁকোতে।
একটু সুস্থ বোধ করতেই কবি আবার চললেন শান্তিনিকেতন। তাঁর প্রাণের আরাম যে সেখানেই। বেশিদিন শান্তিনিকেতন ছেড়ে তাই যেন থাকতে পারেন না। যদিও শরীর তাঁর মনের ইচ্ছেতে ইদানীং ভালোমতোই বাধ সাধছে। আশ্রমে মাঘ উপাসনায় কবির আসন থাকল শূন্য। সকলেই গেলেন যথানিয়মে। কবি যেতে পারলেন না। একা একা বসে কবিতা রচনা করেই সারলেন তাঁর কাজ। লিখলেন, ‘সৃষ্টিলীলাপ্রাঙ্গনের প্রান্তে দাঁড়াইয়া/ দেখি ক্ষণে ক্ষণে/ তমসের পরপার/ যেথা মহা অব্যক্তের অসীম চৈতন্যে ছিনু লীন।’ … সেবার নববর্ষের সময় পাঠ করা হল কবির ‘সভ্যতার সংকট’। কবি নিজে অবশ্য পড়লেন না, পড়লেন ক্ষিতিবাবু। আর কবি মজা করে বললেন, ‘আমায় তো পড়তে দিলে না! পড়লে কি ক্ষিতিবাবুর থেকে খারাপ কিছু পড়তুম!’ হাসি-আনন্দে দিন কাটে বটে! কিন্তু চোরা উদ্বেগ থেকেই গিয়েছে। আশ্রমের সবাই চিন্তিত কবির শারীরিক অবস্থা নিয়ে। চিন্তিত কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। চিকিৎসকরা নানারকম মতামত জানাচ্ছেন। কোনটি যে গ্রহণীয়, তা বেছে নেওয়া ভারি মুশকিলের। পরিচিতজনকে চিঠি লিখছেন রথী ঠাকুর, জানাচ্ছেন তাঁর উদ্বেগ, চিন্তার কথা। কবির অবশ্য এখনও ইচ্ছে নেই অপারেশনে। বরং খানিক মতি আছে কবিরাজিতে। তাঁর ইচ্ছেমতোই এলেন কবিরাজ। জানা গেল, কবির নাড়ির গতি বেশ ভালো। চিকিৎসায় কাজ হবে। কবি বললেন, তাহলেই হবে। হাতের আঙুলগুলো সব আড়ষ্ট হয়ে পড়েছে, একটু লিখতে-টিখতে পারলেই হল। এই বয়সে তো আর তিনি লাফালাফি করতে যাচ্ছেন না। চিন্তার ভিতরও সকলে তাঁর কথা বলার ধরনে হেসে ফেলেন। যদিও কবিরাজিতে ঠিকঠাক ফল মিলল না। ঠিক হল, কবিকে শান্তিনিকেতন থেকে ফিরিয়ে আনা হবে কলকাতায়। ২৫ জুলাই ধার্য হল দিন। কবি ছাড়লেন তাঁর সাধের শান্তিনিকেতন। গাড়ি চলল ধীরে ধীরে। প্রাণভরে সবকিছু দেখ নিচ্ছেন কবি। গ্রামের লোকেরা হাতজোড় করে প্রণাম জানাচ্ছেন তাঁকে। ক্রমে শেষ হয়ে এল শান্তিনিকেতনের সীমা। গাড়ি চলল স্টেশনের দিকে। চোখের উপর রুমাল চাপা দিলেন কবি।
কবির যত অনিচ্ছেই থাক, অপারেশন কিছুতেই আটাকানো গেল না। চিকিৎসকদের মধ্যে ভিন্নমত ছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত সকলে অপারেশনেই থিতু হলেন। প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলেন কবি। শিশুর সারল্যে তিনি কেবল জানতে চান, অপারেশনের সময় তাঁর বিশেষ লাগবে কি না। চিকিৎসক অভয় দিয়ে জানান, তেমন কিছুই লাগবে না। বড়জোর ইঞ্জেকশন দেওয়ার মতো। আশ্বস্ত হন কবি। কলকাতাতে ফিরেও চলছে কবিতা রচনার কাজ। মুখেমুখে বলে যান কবি। পাশে যে থাকে, সে লিখে নেয়। ঠিক হল ৩০ জুলাই কবির অপারেশন হবে। শুনে একটু গম্ভীর হলেন কবি। আসন্ন ঘটনার জন্য তৈরি করলেন নিজেকে। অপারেশন হল ভালোয় ভালোয়। যদিও সফল হল বলা যায় না। কবি ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগলেন। ক্রমে হিক্কা শুরু হল তাঁর। পাশে থাকা নির্মলকুমারী মহালানবিশকে কাতর কণ্ঠে বলেন, তুমি আমার কেমন হেড নার্স , কমাও আমার হিক্কা। উদ্বেগ বাড়তে থাকে পরিচিত পরিসরে। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে আসেন কবির পত্রবধূ প্রতিমা দেবী। কবি তখন আচ্ছন্নপ্রায়। বলছেন, আর আমাকে জ্বালাস না। চারিদিক থমথমে। একে একে এসে দেখা করে যাচ্ছেন পরিচিতজন। কবি যেন সকলকেই নীরবে বলছেন, হে বন্ধু, বিদায়…। ৭ আগস্ট ১৯৪১, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ। ঘনিয়ে এল বাঙালির সূর্যাস্ত। চলে গেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
কবিকে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে নিমতলা শ্মশানের দিকে, তখন উত্তাল জনতা। নিয়ন্ত্রণ হারা মানুষের সমুদ্র। কবির মৃত্যুদিনে যেন নান্দনিকতা বোধেরও অপমৃত্যু। সেদিন এক অভূতপূর্ব ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলেন মৃণাল সেন, যে ট্র্যাজেডির অনুভব থেকে তিনি পরবর্তীতে কিছুতেই নাম বদলাতে চাননি তাঁর ছবির। বাইশে শ্রাবণ একদিকে যেন অসীম শূন্যতার দিন, তেমনই যেন আমাদের আত্মসমালোচনারও দিন।