‘বড় দীর্ঘতম বৃক্ষে বসে আছো, দেবতা আমার / শিকড়ে, বিহ্বল প্রান্তে, কান পেতে আছি নিশিদিন’ – লিখেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। যেন কোনও এক অধরা ঈশ্বরের কাছে তিনি সমর্পণ করতে চাইছেন তাঁর সর্বস্ব। তবে এ কিন্তু মোটেও চিরাচরিত কাঠামোর ঈশ্বরভাবনা নয়। এই দেবতার ধারণাটি এসেছে লোকায়ত ধর্মবিশ্বাস থেকে। বাউলের, ফকিরের, দরবেশের চিরায়ত সন্ধান থেকে।
কবির সেই বাউলমনের সন্ধানে অন্তরা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কবির প্রতিকৃতি: দীপঙ্কর ভৌমিক।
‘এই আসছি’ বলে বেপাত্তা হতেন তিনি। খোঁজ মিলত না দিনের পর দিন। ফুরোত না স্ত্রী মীনাক্ষীর অপেক্ষা। তারপর হঠাৎ একদিন পাওয়া যেত হদিশ। নেপাল কিংবা চাইবাসায়। কবিতার মতো শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর জীবনকেও যেন বইয়ে দিয়েছেন পথের ধুলোয়। তবে তাঁর উড়নচণ্ডী জীবনযাপনের কোথাও কি ঠাঁই পেয়েছিল এক গভীর আধ্যাত্মিকতার বোধ! তাই কি তাঁর কবিতায় মাঝে মাঝেই ধরা পড়ে গেছে সেসব ভিতরের কথা?
‘বড় দীর্ঘতম বৃক্ষে বসে আছো, দেবতা আমার / শিকড়ে, বিহ্বল প্রান্তে, কান পেতে আছি নিশিদিন’ – লিখেছিলেন তিনি। বোঝাই যায়, যেন কোনও এক অধরা ঈশ্বরের কাছে তিনি সমর্পণ করতে চাইছেন তাঁর সর্বস্ব। তবে এ কিন্তু মোটেও চিরাচরিত কাঠামোর ঈশ্বরভাবনা নয়। এই দেবতার ধারণাটি এসেছে লোকায়ত ধর্মবিশ্বাস থেকে। বাউলের, ফকিরের, দরবেশের চিরায়ত সন্ধান থেকে। আর এই সন্ধান হল মনের মানুষের সাধনা। যে মনের মানুষ আসলে আমাদেরই ভিতরে অবস্থান করছে। কেন বলছি এমন কথা? কারণ শক্তি চট্টোপাধ্যায় দিনের পর দিন পড়ে থাকতেন গ্রামগঞ্জের বাউল আখড়ায়। তাঁর সঙ্গী ছিল আখড়ার খ্যাপা-খেপীর দল। খমক-দোতারার শব্দ, বাউলের গান। নবীনদাস বাউল, ভবা পাগলা, গৌরখ্যাপা, প্রমুখের আখড়ায় গিয়ে হাজির হতেন শক্তি। যেতেন কেঁদুলির পথে। আর এইসব সহজিয়া সাধক-কবি-গায়েনদের মধ্যে খুঁজে পেতেন নিজেকে।
আত্মসন্ধানী মানুষের উলটোপিঠে গভীর বিষণ্ণতা থাকে। সেই ধারাবাহিকতা থেকে বাদ যাননি শক্তিও। দেখা যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম কবিতার বই ‘হে প্রেম, হে নৈঃশব্দ্য’-এর ৭৬টি কবিতার মধ্যে অধিকাংশ কবিতাতে বারবার এসেছে মৃত্যুর প্রসঙ্গ। আর মৃত্যুর কথায় বারবার ধরা পড়ে গেছে তাঁর ভিতরের অভিমান এবং গভীর দুঃখবোধ। কেননা শক্তি লেখেন ‘নিদ্রা নয়, ধ্যান নয়, বেদনার ব্যথার ভিতরে/ মনোকষ্ট বুকে নিয়ে শুয়ে রয়েছেন একা একা’। বেদনার ব্যথার ভিতর যিনি খুঁজছেন আরও গভীর কোনও ব্যথার সন্ধান, তিনি কতখানি দুঃখবোধ লালন করছেন তাঁর বুকে। বলাই বাহুল্য এ আসলে সহজাত কবির দুঃখবোধ। ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়তে চাওয়ার বাসনা তাঁকে রাত্রিদিন তাড়া করে বেড়াত। তাই তাঁর বুকে ছিল অন্ধকার হতে চাওয়ার আশা। দু-চোখের ওপরে ছিল অন্ধকারের পথে হেঁটে যাওয়ার হাতছানি। সহজাত জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বেদনায় বালকের মতো অভিমানে ভরে উঠেছে তাঁর কণ্ঠ। তাই কবিতায় ফুটে উঠেছে কান্নাভেজা অভিমান, ‘আমাকে তুই আনলি কেন ফিরিয়ে নে’।
তাঁর সমসাময়িক বন্ধুদের কথায় আমরা বারবার পেয়েছি ব্যক্তি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অন্দরের কথা। কবিঘনিষ্ঠ লেখক সমীর সেনগুপ্ত স্মৃতিকথায় লিখেছেন, শক্তির কণ্ঠে ছিল সাধকের গান। ঠিক নাকি রামপ্রসাদের মতোই। ‘হৃদয়ে তোমার দয়া যেন পাই’ – গানটি গাইতে গাইতে তিনি নাকি হারিয়ে যেতেন কোনও এক অলৌকিক জগতে। সেই গান একবার শক্তির গলায় শুনে নাকি সমীর সেনগুপ্তের মনে হয়েছিল, এই গান পাথুরে নাস্তিকের মনেও আধ্যাত্মিক ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। শুধু এটুকুই নয়। অন্য একটি লেখায় তিনি জানাচ্ছেন, গাছগাছালি চেনার অসামান্য ক্ষমতা ছিল শক্তির। হাজার অজানা গাছের নামও জানতেন দেদার। কৌতূহলের বশে প্রিয়বন্ধু শক্তির লেখায় উল্লিখিত গাছগাছড়ার একটি তালিকা বানিয়েছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী বন্ধু শম্ভুলাল বসাক। আর সেই তালিকা দেখলে অবাক হতে হয়। বিশ্বাস করতে অসুবিধা হলেও এটাই সত্যি, যে, সেখানে তিনশোরও বেশি উদ্ভিদের নাম ছিল। গল্পের মতো শোনালেও এ কোনও গল্প নয়। এ এক অবিস্মরণীয় মানুষের ব্যাপ্ত জীবনবোধ।
আর সেই জীবন বোধের জন্যেই ফুটপাথ বদলের ক্লান্ত বিষাদ থেকে তিনি ফিরতে চাইতেন একেবারে শিকড়ের কাছাকাছি। দীর্ঘ নগরজীবনে অভ্যস্ত হলেও আজন্ম তাঁর বুকের ভিতর বেজে উঠেছে ধুলোমাটির আনন্দভৈরবী। এই অহেতুক আনন্দ যেন সহজিয়া সাধনারই সুর। ঠিক যে আঙ্গিক থেকে উপনিষদ আনন্দরূপ পৃথিবীর রূপ,রস, বর্ণ, গন্ধ, স্বাদের তফাৎ বুঝিয়েছে, ঠিক সেই ঘরানাতেই বাউল চিনেছে তার রূপতত্ত্ব। সেই দীক্ষাতেই শক্তি অনিবার্য ডুব দিয়েছেন মানুষের রূপের ভিতর অরূপরতন খুঁজতে। তাই সহজিয়া সাধনার চর্যা বারবার ফিরে এসেছে তাঁর কবিতাভাষায়। শেষাবধি কুয়োর জলে পড়ে থাকা চাঁদ তিনি খোয়াননি। খোয়াননি মানুষের সাধনা। কারণ, মানুষ বড় কাঁদছে…
শক্তি চট্টোপাধ্যায়– এই নাম উচ্চারণে তাই খুলে যায় মানুষের দিগন্ত। আর সেকারণেই বোধহয় কবিসত্তার মধ্যে তিনি লুকিয়ে রেখেছেন বাউলকে। অথবা বাউলই তাঁর মধ্যে লুকিয়েছে এক অনাবিষ্কৃত দ্বন্দ্বের আখ্যান হয়ে। তাই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয় না। একটি সময়পর্ব অন্তর অন্তর তাঁদের মতো কয়েকজন মানুষ শুধু এসে মহাকালের দরজায় টোকা দিয়ে যান।