৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসান। ভারতের বাজারে ফিরল ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’। ১৯৮৮ সালে রুশদির এই বই ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়। অভিযোগ ছিল, এই বইয়ের বিষয়বস্তু ইসলামবিরোধী। সম্প্রতি সেই নিশাধাজ্ঞা সরিয়ে নতুন করে বিক্রি শুরু হল এই বইয়ের।
৩৬ বছরের অজ্ঞাতবাস। মৌলবাদের ছুরি যে স্বরকে রুদ্ধ করে রাখতে চেয়েছিল, এখনও চাইছে, অবশেষে তার মুক্তি। ভারতে আবার পাওয়া যাবে সলমন রুশদির ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’। সাহিত্যের জন্য তো বটেই, সামগ্রিক ভাবে মুক্তভাবনার পক্ষেও এ একরকম সুখের সময়ই। যখন বিদ্বেষ বা গোঁড়ামির রক্তচক্ষু পেরিয়ে মুক্তমনের আশ্রয় খুঁজে নিতে পারে সংস্কৃতি, তখন তা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। রুশদির বইয়ের ক্ষেত্রে এই তাৎপর্য অন্য মাত্রার। কেননা এই বিদ্বেষ-ছুরি যে কেবল তাঁর সাহিত্যকে বিদ্ধ করেছে, তা নয়। আঘাত নেমে এসেছে তাঁর উপরেও। মৃত্যু হয়েছে তাঁর অনুবাদকের। তবু, রুশদি তো রুশদি-ই। ছুরির আঘাতে চোখ হারানোর পরও যে মিঠে-ছুরিতে জীবনকে ফালাফালা করে ফেলা যায়, তাঁর ‘নাইফ’ যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন। রুশদি বোধহয় নিজের উপর সকল আক্রমণ সয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, নিজের সৃষ্টির প্রতি কতখানি বিশ্বস্ত সম্পর্কে থাকতে পারেন একজন স্রষ্টা। এমনকী, মৃত্যুকেও হেলায় রসিকতা করতে পারেন, সেই সত্যির জন্য। সেই রুশদির হাত ধরেই যখন মৌলবাদ পেরনোর দিকে এক ধাপ এগিয়ে যায় সংস্কৃতি, তখন তা একটা দেশের আগামীর চিন্তন-মননের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সবথেকে বড় কথা, একটি সময়ের রাজনীতি কোন পথে এগিয়ে যাবে, তার আভাস মেলে এই ধরনের সাংস্কৃতিক পদক্ষেপেই।
ইতিহাসের সত্যি আর ব্যক্তির সত্যির মোকাবিলা করার নিজস্ব ক্ষমতা আছে ভাষার। এবারের নোবেলজয়ী হান কাং এই প্রসঙ্গ টেনেছেন তাঁর বক্তব্যে, বলেছেন, ‘I believe that language, by its very nature, is inherently resistant to being forcibly suppressed.’ অতএব তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, ‘Even when efforts are made to silence it, the truth will always find a way to be spoken. I think this power of language will remain unshaken.’ এখানে ভাষার অর্থ প্রসারিত। সাহিত্যের আঙ্গিক পেরিয়ে তা আসলে এক বৃহত্তর সাংস্কৃতিক পরিসরের ইঙ্গিত দেয়। যা কিনা সত্যকে সমস্ত রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা পেরিয়েও প্রকাশ করতে পারে। সে শক্তি ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির আছে। রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস মুক্তি পাওয়ার খবর জানিয়ে পেঙ্গুইন র্যান্ডাম হাউস ইন্ডিয়া-র প্রধান সম্পাদক মানসী সুব্রমনিয়াম রুশদির যে কথাটা তুলে এনেছেন, সেখানে চোখ রাখলে আশ্চর্য হতে হয়। উদ্ধৃতি বলছে- ‘Language is courage: the ability to conceive a thought, to speak it, and by doing so to make it true.’ ভাষার সাহসিকতা হোক কিংবা সাহসিকতার ভাষা- এই যে সত্যের প্রতি নিষ্ঠ থাকা, তা বলতে পারা, এবং বলার দরুনই সত্যের আত্মপ্রতিষ্ঠা সন্দেহাতীত ভাবেই সেই সাংস্কৃতিক পদক্ষেপ, যা রাজনীতিকে স্পর্শ করে। তাকে নতুন অভিমুখ খুঁজে দেয়।
১৯৮৮ সালে রুশদির বই নিষিদ্ধকরণের ভিতরও সেই ইঙ্গিতই ছিল। খোমেইনির গন্ডগোলের আশঙ্কা ইত্যাদি পুরনো কথা আর নতুন করে পাড়ার দরকার নেই। তবে এ কথা ঠিক যে, সাড়ে তিন দশক আগের সেই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র একটি বইয়ের ভিতর আটকে থাকেনি। শুধুমাত্র একটি ধর্মবিশ্বাসেও আটকে থাকেনি। ধর্ম এবং রাজনীতি এক সূত্রেই সেখানে ধরা দিয়েছিল। ধর্ম-রাজনীতি-সেন্সরের ত্রিফলা যেহেতু সক্রিয়, সুতরাং রুশদির বই নিষদ্ধ হওয়া একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। রুশদিকে জীবনভর এর মোকাবিলা করতে হয়েছে। আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আক্রমণে দৃষ্টিও হারিয়েছেন। তবু ওই ভাষার সাহস এবং সত্যি বলতে পারার সাহস থেকে তিনি সরে আসেননি। সেখানে রুশদির আত্মগোপন ছিল না কখনও। বরং এই মৌলবাদী ফতোয়া ও রক্তচক্ষুকে তিনি যেভাবে মশকরা বা রসিকতার ছলে দেখেছেন, তা এক অন্যরকম ভাষার জন্ম দিয়েছে। শুধু ‘নাইফ’-এর লেখা নয়,রুশদির জীবন এক রকমের সাংস্কৃতিক পরিসর হয়ে উঠেছে যা নিষিদ্ধকরণের রাজনীতিকে শুধু এলেবেলেই করে দেয়নি। বরং খানিক ঠাট্টাই করেছে। সাড়ে তিন দশকের অজ্ঞাতবাস পেরিয়ে রুশদি যখন তাঁর সাহিত্য এবং সত্যি নিয়ে ফিরছেন, তখন তা এক নতুন ধরনের স্বীকৃতি হয়ে ওঠে। এবারেও শুধু একটি বইয়ের মুক্তি নয়। বলা যায়, তা এক ধরনের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাংস্কৃতিক ইঙ্গিত। যে রাজনীতি তাঁকে নিষিদ্ধ করেছিল, সেই রাজনীতিই কি তাহলে এখন আত্মগোপনে? নাকি সে-রাজনীতি সক্রিয় হলেও আর তার জোর নেই! এ আলোচনার পরিসর নিঃসন্দেহে খুলে গেল।
তবে মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রে ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’-এর মুক্তি মাইলফলক হয়েই থাকবে। একদা রুশদি যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন, খানিক হেঁয়ালি করেই, সেখানে বহু মত বহু বিশ্বাসের সহাবস্থানের কথাই বলেছিলেন। বিশ্ব রাজনীতি যখন বদলাচ্ছে, যখন এই বহুত্বই নিশ্চিহ্নপ্রায় বলে মনে করছেন সমাজতাত্ত্বিকরা, ঠিক তখনই এই মুক্তি-সংবাদ। খানিকটা যেন প্যারাডক্স। তবে এই বাঁকে দাঁড়িয়েই নতুন অভিমুখের দেখা মেলে। রুশদির সঙ্গে নতুন করে পরিচয়ের পাশাপাশি, সেই নতুনের সঙ্গেও নিশ্চিত এবার পরিচয় হবে।