একজন মানুষকে কি আর-একজন মানুষ পুরোপুরি চিনে উঠতে পারে! হতে পারে, দুজনের সম্পর্ক নিবিড়। হয়তো স্বামী-স্ত্রী কিংবা মা-মেয়ে। তারপরে চেনা-অচেনার মধ্যে থেকে যায় অনেকখানি ধূসর জমি। সামাজিকতার শো-কেসে যে মানুষ সাজানো, তার অন্তরমহলের অশ্রুত কথামালা জড়ো করলে নির্মিত হতে থাকে আর-একজন মানুষ। তাঁর মুখোমুখি হতে কি আমরা প্রস্তুত থাকি? কতটা অস্বস্তির সম্ভব-সম্ভবে মেলানো সেই দ্বিতীয় বাস্তবতা? শর্মিষ্ঠা গুপ্তুর উপন্যাস ‘আনস্পোকেন’ পড়তে পড়তে সেই সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংশয়ের মুখোমুখি হলেন অরিঞ্জয় বোস।
মায়ের প্রেমিক! অকস্মাৎ একদিন যদি পরিণত বয়সের সন্তান আবিষ্কার করে, যে, বাবা ছাড়াও তার মায়ের আর-এক ভালবাসার পুরুষ আছে বা ছিল, তবে সেই মুহূর্তের মুখোমুখি হওয়া কতখানি সহজ? মোটেও সহজ নয়, এমনকী আজকের দিনে হলেও নয়। আমাদের তথাকথিত প্রগতিশীলতার ভিতরও ধারণার প্রাচীন শিকড় সাজিয়ে রাখে পিছুটান। সেখানে আঘাত এলে আমাদের চেনা সংগঠন ভেঙে পড়ে। অথচ মানুষ তো একমাত্রিক, একরৈখিক হতে পারে না। মানুষ কখনই তার নিজের বানানো পলিটিক্যাল কারেক্ট প্রতিবিম্ব নয়। তার রক্ত-মাংসের মধ্যে খেলা করে দোষ-গুণ-ঈর্ষা-ভালবাসা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা-হিংসা-রিরংসা। যা সে প্রকাশ করে না, আবার তা যে চিরকাল অপ্রকাশ থাকবে তা-ও নয়। মানুষ বলেই তা সম্ভব নয়। অর্থাৎ মানুষের একটা সাজানো দিক যা আপাত সামাজিক। আর তা পেরিয়ে থেকে যায় তার নিজস্ব সত্তা, যা থেকে দূরত্ব ক্রমশ বাড়ে। দূরত্বের এই চাপ মানুষ আজীবন বহন করে। আবার কখনও কোনও মুহূর্তে মনের বসতবাড়িতে আলাদা আলাদা কুঠুরির দরজাগুলো খুলে গেলে সব একাকার হয়ে যেতে থাকে। অতীত, বর্তমান তখন মিলেমিশে খাড়া করে আর-এক সত্যিকার বাস্তবতা, যা মোকাবিলায় আমাদের চেনা বাস্তব প্রস্তুত নয়। সে বাস্তবতার কথা প্রায় বলাই হয় না, কেন-না তা অস্বস্তিকর। শর্মিষ্ঠা গুপ্তুর ‘আনস্পোকেন’ উপন্যাসটি পাঠককে নিয়ে যেতে চায় সেই অস্বস্তির সমীপেই, যেখানে সাজানো শৌখিন সত্তা অতিক্রম করে বেরিয়ে আসে মানুষের স্বরূপ।
আরও শুনুন: ছোট মুখে বড় কথা! ডা’কুনহার আমূল-বালিকাই বিজ্ঞাপনের ‘টেস্ট অফ ইন্ডিয়া’
উপন্যাসের ‘মিসেস জি’ চরিত্রটি পাঠককে ক্রমশ সত্যিকার মানুষের মুখোমুখি করে তোলে। মুনশিয়ানার সঙ্গেই লেখক এখানে আইশা চরিত্রটিকে পাঠকের সত্তার সঙ্গে মিশিয়ে দেন। গল্পের খাতিরে সে মিসেস জি-র কন্যা। গোড়াতেই যে-প্রশ্নের প্রসঙ্গ এসেছে, সে-প্রশ্ন বিভ্রান্ত করেছে তাকে, এবং পাঠককেও। অতএব পাঠক এবং আইসা একসঙ্গে যেন একটা রহস্য সমাধানেই নামে। মিসেস জি জানাচ্ছেন, তাঁর সেই ভালবাসার পুরুষটি হলেন ‘মিঃ এ’। কেন মানুষ তার পূর্ণ নাম ছেড়ে এমন অক্ষর হয়ে উঠছে? আইশা তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে। হতে পারে এই সংক্ষেপ আসলে সংকেত। একটা সময় বোঝা যায়, এ আসলে মানুষের অন্য রূপ। আইশা যাঁকে মিউ বলে ডাকে, তাঁর আর মিসেস জি-এর মধ্যে অনেক তফাৎ। যদিও শারীরিক ভাবে দুজনেই এক ব্যক্তি। মিউ, আইশা আর আইশার বাবা মিলে এক চূড়ান্ত সফল সামাজিক সংগঠন। ছোট পরিবার, সুখী পরিবার। আইশা জানে, সেখানে ভালবাসা উপচে পড়েছে আজীবন। অথচ আইশা এবং পাঠক দুজনেই যখন পরতে পরতে আবিষ্কার করতে থাকেন মিসেস জি-কে, তখন বোঝা যায়, তিনি ভালবসার কাঙালও হতে পারেন। অতএব তাঁর কর্মক্ষেত্রে থেকে যেতে পারে আর-এক জীবন। যেখানে এক পুরুষকে কেন্দ্র করে জড়িয়ে পড়তে পারেন দুই নারী। ঈর্ষার কাঁটা মনের কোমলতাকে বিঁধতে পারে তীক্ষ্ণ। কারও মনে হতে পারে শরীর জুড়ে এই যে বাসনাতৃপ্তির আয়জন তা বুঝি বৃথা, কেননা ওই পুরুষের দৃষ্টি বিহনে আশ্লেষের লগ্ন বয়ে যায়। আবার সেই পুরুষটির উদাসীনতা অন্য নারীকে আরও বেশি করে ফিরিয়ে দিতে পারে তাঁর ঘরের পুরুষের প্রতি। কিন্তু সেখানে ভাঙা কাচের মতোই হয়ে উঠতে থাকে অপর নারীর ভূমিকা। এখন এই দোলাচলে যদি গল্প গিয়ে পৌঁছায় এমন এক বিন্দুতে, যেখানে দেখা যায়, ‘মিসেস জি’ আর ‘এ’ ব্যতিরেকে এই কাহিনির আর-এক নারী শ্রী বোস আত্মঘাতী হয়েছেন, তাহলে আরও এক প্রশ্ন উত্থাপিত হয় আইশার সামনে। তার মা কি কোনওভাবে এই মৃত্যুর জন্য দায়ী? আইশা এবং পাঠক আবার এক দ্বন্দ্বাকীর্ণ যাত্রায় নামে। রহস্যের উদ্ঘাটন আইশা এই কারণেই চায়, নইলে সে হারিয়ে ফেলে নিজেকে, তার নিজের জীবন-পরিবার-সম্পর্ক সম্পর্কে অনেকখানি ধারণাকে। সত্যি বলতে, এই উত্তর না-মিললে আইশা হারাবে তার নিজের জীবনের একাংশকে।
আরও শুনুন: উস্তাদ বড়ে গোলাম আলির ‘হরি ওম্’, ভীমসেন যোশির আল্লা-উপাসনা… সংগীতে মুছে যায় ধর্মের বিভেদ
তবে এই উত্তর খোঁজাই এ-উপন্যাসের একান্ত উদ্দেশ্য নয়। তা আসলে খুঁজতে চায় মানুষকে। হয়তো, মিসেস জি যা বলছেন, যা সংকেত দিচ্ছেন সবই নেহাত গল্প। ছোটবেলায় বাবার থেকে যে প্রত্যাখান পেয়েছিলেন, তা-ই জমে জমে মনে পাথর হয়ে আছে। সেই পাথরের সঙ্গে তিনি মিলিয়ে নিচ্ছেন তার চারপাশকে, ফলে জন্ম নিচ্ছে এক-একটা গল্পের। যা কিনা আলাদা একজন মানুষকেই নির্মাণ করছে। আইশার মা হয়ে উঠছে সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন। এমন একটা জীবন তাঁর কাছে তালাবন্ধ হয়ে আছে, যার চাবি কোনদিন আইশাদের কাছে ছিল না। অতীত যেন এক জন্মান্তরের কাহিনি। সেখানে অন্য মানুষ, অন্য বাস্তবতা। বর্তমান তার নাগাল পায় না। আর হৃদয়পুরের জটিলতায় যদি সেই দুই সময়কাল মিলেমিশে যেতে থাকে, পাশাপাশি চলে আসতে থাকে থাহলে এই অকথিতের সূত্র ধরেই জন্ম হতে থাকে নতুন আখ্যানের। আসলে নতুন মানুষের। হয়তো তা সত্যি, কিংবা নয়। কাহিনির বিন্যাস অতীত-বর্তমান হয়ে তাই এগিয়ে যায় ভবিষ্যতের দিকেও। যা ঘটেছে তা ধোঁয়াশাময়, যা ঘটমান তা অস্বস্তির, অতএব এই বিভ্রম মুক্তির জন্য কাহিনিকে এগিয়ে যেতে হয়, যা ঘটতে পারে সেদিকেও। সময়ের অক্ষরেখা ধরে কাহিনির এই যাতায়াত আসলে সময়ের তির ধরে মনেরই হাঁটাচলা। দ্রুতগামী মন তো এভাবেই অতীত-বর্তমান এমনকী আগামীর দিকেও ধেয়ে যেতে পারে। হয়তো এভাবেই সেই বোধে পৌঁছনো যাবে যে, মানুষ মূলত একা। একলার ক্রন্দন তার বুকের মধ্যে অহরহ। বারাণসীর ঘাটে দাঁড়িয়ে আইশা বুঝতে পারে, নদীতে ভাষা নৌকার মতোই একাকীত্বের অভিশাপ কুড়িয়ে ভেসে আছে এক-একজন মানুষ। ভিড়ের মধ্যেও এই একলা মানুষ খুঁজে ফেরে আর-একজন মানুষকে, যে মানুষ হয়ে তার পাশে দাঁড়াতে পারে। তাকে ভালবাসতে পারে। এ-উপন্যাস তাই আসলে ভালবাসার কাঙাল মানুষেরই অন্তরতম কথকথা হয়ে ওঠে।
আরও শুনুন: সুমন যেন অমোঘ সংক্রমণ, বাঙালিকে আধুনিক উচ্চারণে বলতে শেখালেন ‘তোমাকে চাই’
আমরা বুঝি, সামাজিকতায় মোড়া মানুষ সবথেকে অযত্ন করে তার মনেরই। তার ইচ্ছে-অনিচ্ছের। তার কামনার কাঁচা রং সে চাপা দিয়ে দেয় দক্ষতায়। অর্থাৎ মানুষ তার নিজের ভিতরেই নিজেকে সমাধিস্থ করে রাখে। তার নিজস্ব কথাগুলো যাতে চিরকাল অশ্রুত থেকে যায়, সে বন্দোবস্ত করে নিজের হাতেই। কোনও একদিন মনের দরজাগুলো হাট করে খুলে গেলে মানুষের রূপ বদলে যায়। সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য মিলেমিশে যেতে থাকে। গল্প আর বাস্তব তখন কে যে কার থেকে আলাদা, তার হদিশ মেলে না। চেনা ফুলদানি ভেঙে একদিন হঠাৎ যেন ছড়িয়ে পরে কাগজের ফুল, যাকে এতদিন অবিকল সত্যি কুসুম বলে চিনে এসেছিল পৃথিবী। হৃদয়কুসুমের এই খোঁজই আসলে অধরা এবং অশ্রুত। লেখক যেন মনে করিয়ে দেন, মাপে-মাপে বয়ে চলা এই জীবনের সবটুকুই সত্যি নয়। বরং যা অকথিত, যা অশ্রুত তা যদি সামনে আসে তবে জীবনের এক পূর্ণাঙ্গ বয়ান সামনে আসতে পারে। মনের ভিতরকার মানুষটিই সত্যি। নিখাদ। নির্ভেজাল। স্বরচিত দূরত্ব অতিক্রম করে তার কাছে পৌঁছনো এক সময় চরম অস্বস্তির বলেই, সময় থাকতে তার যত্ন নেওয়া জরুরি। ‘আনস্পোকেন’ আসলে মানুষকে বলে ভালবাসতে, সবার আগে নিজেকেই।
উপন্যাস- আনস্পোকেন
শর্মিষ্ঠা গুপ্তু
সাইমন অ্যান্ড শুসটার (Simon & Schuster)
৪৫০.০০