বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম মুখ ছিলেন তিনি। অস্তিত্ব আর দর্শনের ভিতর দিয়ে আখ্যানকে তিনি চালিত করেছিলেন এক অন্যতর দিগন্তে। এবার সেই আখ্যানের ভুবন পেরিয়ে অন্য পৃথিবীতে পাড়ি দিলেন মিলান কুন্দেরা। আর ফেলে যাওয়া পৃথিবীতে রেখে গেলেন মানুষের চিন্তা উসকে দেওয়া প্রশ্নদের।
তাঁর লেখাকে যদি নেহাতই রাজনৈতিক বলা হয়, তবে তা অতিসরলীকরণ হবে। একদা এক সাক্ষাৎকারে এ-কথা বলেছিলেন মিলান কুন্দেরা। অবশ্য এই ‘রাজনৈতিক’ অভিধা কুন্দেরার লেখাজীবনের চিরকালীন সঙ্গী হয়েই থেকেছে। এবং তা যেন খানিকটা স্বাভাবিকই। চেক প্রজাতন্ত্রের কমিউনিস্ট জমানার যে সমালোচনাটি তিনি আখ্যানের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, তার নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য জোক’। এই ঠাট্টা কি শুধু তাঁর সমসময়ের প্রতি লেখা খোলা চিঠি? বা, কোনও দলের জন্য তুলে রাখা বিদ্রুপের এক চিলতে মুচকি হাসি! আপাত ভাবে তা মনে হতে পারে। এমনকী চেক ছেড়ে নির্বাসনকে নিয়তি করে কুন্দেরাকে চলেও যেতে হয়েছিল ফ্রান্সে। তবে কুন্দেরা বোধহয় এই ঠাট্টার অভিমুখ ঘুরিয়ে রেখেছিলেন তাঁর নিজের দিকে। তাঁর অস্তিত্বের দিকে। আখ্যানবিশ্বে অস্তিত্ব আর দর্শনের প্রশ্নগুলিকে মোকাবিলা করতে-করতেই এগিয়েছেন কুন্দেরা। আর প্রায় নিয়তিনির্দিষ্ট হয়েই তাঁর রচনার সঙ্গী হয়ে উঠেছে রাজনীতি।
নির্বাসিতের আত্মকথা। হয়তো কুন্দেরার লেখাকে এই আখ্যায় খানিকটা ধরা যেতে পারে। তবে এই নির্বাসিত মানুষটিকে শুধুমাত্র দেশের গণ্ডিতে বাঁধা যায় না। এ কথা ইতিহাসস্বীকৃত যে, কুন্দেরার জীবনের সঙ্গে নির্বাসন জড়িয়ে গিয়েছে। এক সময় নিজের মাতৃভাষায় লেখা পাণ্ডুলিপিগুলো তাঁর ড্রয়ারেই বন্দি হয়ে পড়ে থাকত। সেই আক্ষরিক নির্বাসন পেরিয়েও আরও এক নির্বাসিতের কথন হয়ে ওঠে কুন্দেরার আখ্যান। প্রথমে যে সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ এসেছিল, সেখানেই কুন্দেরা বলেছিলেন, রাজনৈতিক অতিসরলীকরণের বাইরে বেরিয়ে তাঁর লেখার প্রকৃত তাৎপর্যের পাশে গিয়ে যেন দাঁড়ান পাঠক। আর ঠিক সেই কাজটি করতে গেলেই এই ক্রমাগত বদলাতে থাকা বিশ্বে একজন একাকী মানুষের কথন ক্রমশ উঠে আসে। যে মানুষ রাজনৈতিক প্রেক্ষিতেই মিলিয়ে দেখছে তার অস্তিত্বকে। লোভ-লালসা-ঈর্ষা-যৌনতা-সংরাগ-বীতরাগের যে অস্তিত্ব রক্তমাংসে জায়মান, সেটিকেই সে মেলে ধরে সমকালের পটে। আর সেখান থেকেই ক্রমাগত জন্ম নিতে থাকে সংশয় ও সংকট। দর্শন আর জীবনের সেইসব মোকাবিলা বা প্রশ্নোত্তর পেরোতে পেরোতেই একটা একটা ডিসকোর্সের পরিসর খুঁজে নিতে চায় কুন্দেরার আখ্যান। বা সেই একাকী নির্বাসিত মানুষ। যে মানুষ জানে টোটালিটেরিয়ান শক্তি এসে মানুষের অতীত ও ইতিহাস মুছে আর-এক বিকল্প অতীতের জন্ম অব্দি দিতে পারে। অর্থাৎ নিজেরই অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন হবে সেই নির্বাসিত মানুষের বেঁচে-থাকা। অথবা তার বেঁচে থাকা বদলে যাবে এমন এক বাস্তবতায়, যার কুশীলব সে নিজে বটে, কিন্তু তার নিয়ন্ত্রণ তার নিজের হাতে নেই। অতএব কুন্দেরা যে ‘দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’ রচনা করবেন, তা যেন সময়ের ইতিহাসেই লেখা। আসলে এই আত্মদর্পণের সামনে দাঁড়ানো মানুষের অবধারিত অবস্থান। তার একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা, নির্বাসন তথা অস্তিত্বের স্বরূপ চেনাটাই তার রাজনৈতিক কাজ। অথবা প্রকৃত তাৎপর্যে জীবনের দর্শন। সুতরাং ‘দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিয়িং’-এ এসে নিৎসের সঙ্গেও একহাত এক্কা দোক্কা খেলে নেবেন কুন্দেরা। অস্তিত্বের ভার আর ভারহীনতার অসহ বোঝা তখন মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। আসলে এই অস্তিত্বের ব্যবচ্ছেদেই কুন্দেরা আধুনিক মানুষকে আলো-অন্ধকারে এনে দাঁড় করেন। আর সেখান থেকেই সম্ভাবনা নতুন বোধের জন্মের।
নোবেল পাননি কুন্দেরা। হয়তো নোবেল দিয়ে তাঁকে পরিমাপ করাও সম্ভব নয়। কুন্দেরা তাঁর আখ্যানে যে ‘এক্সিস্টেনশিয়াল কোড’ পাকড়াও করার কথা বলেন, সেই পরিসরেই তো চলতে থাকে আধুনিক মানুষের অবিরত সন্ধান। এই নানা ভাবে বিপর্যস্ত বিশ্বে মানুষ যে একাকী বিস্ময়ে ক্রমাগত ভ্রমে, তার ভ্রম-ভ্রান্তি-সংকটের রূপরেখার অনুসন্ধানই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। আবার তার বেঁচে থাকাই তাকে এই সন্ধানে রত করে। সেখান থেকে কি নতুন বিশ্বের সন্ধান মেলে? কুন্দেরা কোনও নির্ণয়ের কাছে পাঠকে পৌঁছে দিতে চান না। তবে দর্শন আর আখ্যানের এক্কা-দোক্কায় মোকাবিলার চিহ্নগুলিকে রেখে যান। যা বিশ্বমানবের সম্পদ। বিশ্বমানবতার সঙ্গে সেই সংলগ্নতার নিরিখেই আধুনিক কথনবিশ্বের ঐশ্বর্যময় আখ্যানপুরুষ হয়ে উঠেন কুন্দেরা। ৯৪ বয়সে তাঁর প্রয়াণ হল। তবে অস্তিত্ব আর দর্শনের ভিতর দিয়ে আখ্যানের এই পথচলাকে তিনি অনন্তে পৌঁছে দিলেন। মানুষের ভাবনা কুন্দেরাকে বাদ দিয়ে আজ আর এগোতে পারে না কিছুতেই।