উস্তাদ জাকির হুসেনের দর্শন তাঁর সঙ্গীতকে দিয়েছে অন্য মাত্রা। পৃথিবীর মানবতাবাদী দর্শন যে বিশ্বমানবিকতার কথা বলে, সন্ধান করে, মানুষের যে অবিচ্ছিন্ন সূত্রের কথা স্মরণ করায়, যে পূর্ণের সাধনা করে, জাকির সেই ঘরানারই অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাধক। তবলা হাতে তিনি তাই যেন আদতে দার্শনিক।
তিনি ধ্রুপদী। তবে গণ্ডিবদ্ধ নন। তিনি দীক্ষিত শ্রোতার পরিমিত মার্জিত ‘কেয়া বাত!’, আবার তিনিই রসিক শ্রোতার মনে ঝড় তোলা অপরূপ মাতন। ভারতীয় রাগসঙ্গীতকে গণমানুষের দুয়ারে পৌঁছে দেওয়ার দুরূহ কাজটি তিনি করতে পারতেন আশ্চর্য সরলতায়। তিনি সরস্বতীর সেই বরপুত্র, সঙ্গীতের সূত্রে যিনি বিশ্বের মানুষকে বেঁধে ফেলতে চেয়েছেন এক সূত্রে।
একজন তবলাবাদক আসলে কে? উস্তাদ জাকির হুসেন বলতেন, মঞ্চে আসলে তিনি হয়ে উঠবেন একজন সাইক্রিয়াটিস্ট। যাঁর কাজ, সহশিল্পীর মন পড়ে ফেলা। প্রথম বেশ কয়েক মিনিট তিনি পাশের শিল্পীকে পর্যবেক্ষণ করবেন। কোন কম্পোজিসনে কোন রং ছড়াতে চাইছেন শিল্পী, তা তিনি ভালো করে বুঝে নেবেন। অর্থাৎ সঙ্গীতের যে-ভাষা ও পথ শিল্পী ধরেছেন তা বুঝে নিয়েই এবার সে পথে এসে দাঁড়াবেন তবলাবাদক স্বয়ং। তারপর ঘনিয়ে উঠবে এক কথোপকথন। চলবে তর্ক-বিতর্ক। চাপান-উতোর। সুরের পথে পথে যে অনিশ্চয়তা, তাল-লয়ের হাত ধরে সেই পথে হাঁটবেন দু’জন। আর এই পথ চলার আনন্দ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবেন শ্রোতা। কারণ, তাঁরা জানেন এই যে পথ চলা এ আসলে পৌঁছবে সেই গন্তব্যে, যা সবকিছু মিলিয়ে দিতে পারে। মানুষকে পৌঁছে দিতে পারে মানবে।
শিল্পীর চলা গভীর নির্জন পথে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে এই পরিক্রমা এমন এক স্বরসঙ্গতির কথা বলে, বলে বহুবচন মিলেমিশে যেন সংলাপ বা ডায়লগ ঘনিয়ে তোলার কথা। যা কাউকে ক্ষুণ্ণ করে না। কারুর মতকে খাটো করে না। অথচ কারোর স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হয় না। অর্থাৎ পথিক দু’জন পরস্পরের হাত ধরে চলতে চলতেই যেন নতুন এক মহাকাশ আবিষ্কার করেন। আর সেই মহাকাশের মহাবিস্ময় উপহার দিতে পারেন সামনের অগণন মানুষকে। জাকিরের আজীবনের সাধনা যেন সেই মহাকাশেরই সন্ধান।
সুরের সংসারেই তাঁর বড় হয়ে ওঠা। তিনি নিজে বলতেন, যে বাড়িতে চব্বিশ ঘণ্টাই সুরের চলাচল, সেখানে আলাদা করে কিছু আর করতে হয় না। গোটা বিশ্বের দর্শক জানেন, জাকিরের হাত যখন তবলার উপর পোষা পাখি, তখন এই আশ্চর্য সরলতা আর সহজতাই সকলকে আবিষ্ট করে তুলত। রাগসঙ্গীতের দুরূহ পথেই তাঁর হাঁটা। কিন্তু দুরূহতাকে যেন খানিক আড়াল করেই রাখতেন বরাবর। সঙ্গীতের সাধনায় তাঁর যে সিদ্ধাই, তা কখনই প্রকাশ করতেন না। বরং এই সরলতার গুণেই ধ্রুপদী হয়েও তিনি পৌঁছে যেতে পারতেন সাধারণ শ্রোতার দরবারে। পাণ্ডিত্য যে কালোয়াতি নয়, বরং বহুজনকে সরল অনুভবে স্পর্শ করতে পারার মধ্যেই যে আছে প্রজ্ঞা- জাকির তা প্রমাণ করেছেন। তিনি বিশ্বশ্রুত। সারা পৃথিবীর সঙ্গীতসাধক তাঁকে কুর্নিশ করেছেন। তবু ওই একজন সাইক্রিয়াটিস্টের মতোই তিনি যেন শ্রোতাদের মন পড়তে ভালোবাসতেন। শুধু পাশের বরেণ্য শিল্পীর সঙ্গেই পথচলা নয়, তিনি তাঁর বাজনায় ডেকে নিতেন শ্রোতাকেও। আহ্বান জানাতেন, তাঁর পথে। সে শ্রোতা যদি সঙ্গীতে দীক্ষিত হন, তাহলে নিশ্চিতই আলাদা রস আস্বাদন করতেন। আর তা না হলেও, অনুভবের রং বদল স্পষ্টই ধরা দিত। জাকিরের গন্তব্য ছিল মনের সেই গহনেই। তিনি সঙ্গীতের ঐশ্বর্যটুকু বিলিয়ে গিয়েছেন অকাতরে। মন্ত্রমুগ্ধ দর্শক-শ্রোতা তাঁর বাজনা শেষে জানতেন, জীবনের মহত্তম এক অনুভব সঙ্গী করেই তিনি ফিরছেন।
আসলে সঙ্গীতের এক সার্বজনিক অনুভব মানুষকে উপহার দেওয়াই ছিল বোধহয় জাকিরের বাসনা। ‘মেকিং মিউজিক’। আজ থেকে ৩৬ বছর আগের কথা। প্রথম অ্যালবামের যে নাম রেখেছিলেন জাকিস হুসেন, সেটিকেই তাঁর আজীবনের সঙ্গীতসাধনার সারকথা বলা যায়। ভারতীয় রাগসঙ্গীতের আত্মাটিকে সঙ্গে নিয়েই যে, বিশ্বের সঙ্গীতের ধারার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যায়, সে চেষ্টা অনেক গুণী সঙ্গীতসাধকই করেছেন। জাকির কোথায় আলাদা? রসিক শ্রোতা জানেন, জাকিরের হাতের জাদুতে সঙ্গীত এক অন্য ভাষা পেত। যেখানে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ব্যাকরণ, বৈশিষ্ট্য পেরিয়ে তা অনুভবের সেই অপার জগৎ তৈরি করতে পারত, যা আদতে সঙ্গীতের চূড়ান্ত গন্তব্য। যে বিস্ময়ের জন্য পৃথিবী অপেক্ষা করে, তা বহু সাধনার বলেই আয়ত্ত করেছিলেন তিনি। রাগসঙ্গীতকে আধার করে এই বিস্তারে পৌঁছনো সহজ নয় মোটেও। জাকিরের দর্শনই ছিল বিশ্বের সঙ্গে মোলাকাত এবং মেলবন্ধন। তবে, তা যেন কোনোভাবেই ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত না হয়। তবে, ঐতিহ্যে লগ্ন হয়ে থাকা বলতে কী বোঝায়? তা কি শুধু নিজের ঘরের সম্পদের দিকে ফিরে তাকানো? গভীর থেকে গভীরতর পথের অনুসন্ধান। জাকির তা অস্বীকার করেননি। তবে, সেই ঐতিহ্যের অনুসারী হয়য়েও বিশ্বের দরজা তিনি উপেক্ষা করেননি। সঙ্গীতের অঢেল ভাঁড়ারের দরজা যদি খোলা থাকে, তাহলে সেই অলৌকিক গৃহে প্রবেশ না করার তো কারণ নেই। জাকির বিশ্বাস করতেন, ভারতীয় সঙ্গীত থেকে যেমন বাকি বিশ্ব ঋদ্ধ হতে পারে, ভারতীয় সঙ্গীতও পারে বিশ্বসঙ্গীতকে আত্মস্থ করতে। এবং তা করা উচিত।
একই সঙ্গে পারফরমেন্সের দৃশ্যমানতাতেও তিনি বদল এনেছিলেন। ভারতীয় রাগসঙ্গীত পরিবেশনের মেজাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল পাশ্চাত্যের পরিবেশনার ধারা। যে স্টাইল স্টেটমেন্ট প্রায় সিগনেচার হয়ে উঠল, এবং অনুজ বহু শিল্পী পরবর্তী সময়ে তা অনুসরণ করলেন। বিশ্ব সঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর গাঁটছড়াটিকে তাই বুঝে নেওয়া যায় নানা মাত্রাতেই। বহু কাজই তিনি করেছেন যেখানে ভারত আর বিশ্ব হাত ধরাধরি করেছে, সৃষ্টি হয়েছে সঙ্গীতের অনির্বচনীয় মুহূর্ত।
জাকিরের এই দর্শন তাঁর সঙ্গীতকে যেন অন্য মাত্রা দিয়ে দেয়। বলা যায়, পৃথিবীর মানবতাবাদী দর্শন যে বিশ্বমানবিকতার কথা বলে, সন্ধান করে, মানুষের যে অবিচ্ছিন্ন সূত্রের কথা স্মরণ করায়, যে পূর্ণের সাধনা করে, জাকির সেই ঘরানারই অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাধক। তবলা হাতে তিনি তাই আদতে দার্শনিক। এই ছোট ছোট ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া পৃথিবীকে কে জুড়ে রাখতে পারে? এই দর্শনই। সন্দেহ নেই, সঙ্গীতকে অবলম্বন করে সেই দর্শনেরই আজীবন চর্চা করে গিয়েছেন তিনি।
মানুষ অমৃতের পুত্র। সেই অমৃত মানুষকে যে গুটিকয় মানুষ উপহার দিতে পারেছেন, তাঁদেরই একজন উস্তাদ জাকির হুসেন। তিনি পূর্ণের সাধক। সেই পূর্ণে তাঁর ঐহিক সত্তা মিলিয়ে যেতে পারে জাগতিক নিয়ম। তবে, যতদিন থেকে যাবে সঙ্গীতে মানবতার খোঁজ, ততদিন থাকবে জাকিরের খোঁজ। ছাত্রদের উস্তাদজি বলতেন, সব নিয়ম শেখো। সব গণ্ডি, সীমানা, স্ট্রাকচার বুঝে নাও। তারপর মঞ্চে উঠে সব ভুলে যাও। ঝাঁপ দাও অনিশ্চিতে। অসম্ভবের খেলায়। আকস্মিকের মুহূর্তে। সেই অবিশ্বাস্য সব মুহূর্তেই সরস্বতীর অধিষ্ঠান।
আমরা দেখব, যতবার মূর্ত হয়ে উঠবে সঙ্গীত-সরস্বতী, ঠিক তার পাশটিতেই বসে থাকবেন তাঁর বরপুত্র- উস্তাদ জাকির হুসেন।