রাজা রামমোহন রায়। নব ভারতের প্রাণপুরুষ। সতীদাহের মতো অন্ধকার প্রথা রদ হয়েছিল তাঁরই উদ্যোগে। এবং তা করেছিলেন শাস্ত্রের ব্যাখ্যা মেনেই। কেননা, শাস্ত্রের ভেজাল থেকেই নাকি আমদানি হয়েছিল সতীদাহের মতো নিকৃষ্ট প্রথার। কেন বঙ্গদেশে সতীদাহ এমন মাথাচাড়া দিয়েছিল? কোন পথেই বা রামমোহন তা প্রতিরোধ করেছিলেন? আসুন শুনে নিই।
মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় জোর করে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে তাঁর জীবন্ত স্ত্রীকে। এই বাংলার মাটি সাক্ষী থেকেছে এরকম ভয়াবহ ঘটনার। শাস্ত্র ও ধর্মের নামে গোঁড়ামি, কুসংস্কার এবং ধর্মান্ধতা যে কোন পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে, সতীদাহ বোধহয় তার সবথেকে বড় নিদর্শন। যে ঘটনার বিবরণ শুনে আজও শিউরে উঠতে হয়। এই ঘৃণ্য প্রথার বিরুদ্ধে যিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি আধুনিক ভারতের প্রাণপুরুষ রাজা রামমোহন রায়। শাস্ত্র ব্যাখ্যা করেই তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, শাস্ত্রের নামে এই গোঁড়ামি কতখানি অর্থহীন।
আরও শুনুন: ঈশ্বরের হয়ে আইনি লড়াই লড়বেন কে? আদালতের জবাব, ‘ভগবানের বন্ধু’ ভক্তরাই
দেখা যায়, আর্য সংস্কৃতির যে মূল উৎস, সেই বেদে কিন্তু সতীদাহের মতো কোনও অনুশাসনের উল্লেখ ছিল না। সতীদাহের উদ্ভব হল, বলা যায়, শাস্ত্রের ইচ্ছাকৃত ভুল ব্যাখ্যা থেকেই। ইতিহাসবিদ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এই বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সতীদাহ প্রথা উদ্ভবের পিছনে যে মস্ত অর্থনৈতিক কারণ ছিল, সেই প্রসঙ্গে তিনি জানাচ্ছেন, ” টমসন নামে জনৈক ইংরেজ একবার গণনা করে দেখিয়েছিলেন যে, হিন্দুধর্মের সনাতনবাদীদের পীঠস্থান বারাণসীতে সতীদাহের সংখ্যা ছিল দেড় সহস্র অথচ বাংলাদেশে তার সংখ্যা তখন সাড়ে তিন সহস্র। এর কারণও খুব সুষ্পষ্ট। … বারাণসীতে সন্তানহীনা বিধবার সম্পত্তির অধিকার স্বীকৃত ছিল না। অথচ জীমূতবাহনের দায়ভাগশাসিত বাংলাদেশে সন্তানহীনা বিধবার আজীবন সম্পত্তির অধিকার ছিল স্বীকৃত।” এই তথ্য থেকে আমরা বুঝতে পারি, ঠিক কোন স্বার্থ চরিতার্থতার জন্যই অসংখ্য সন্তানহীনা বিধবা রমণীকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল স্বামীর চিতায়। তবে সেই পুরোটাই হয়েছিল শাস্ত্রের মোড়কে। বলা যায় শাস্ত্রকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে। পুরোহিততন্ত্র যা চাইছিল, তার রূপায়ণ হল নিবন্ধ-লেখক রঘুনন্দনের হাত ধরে। কিন্তু বহু শাস্ত্র মন্ত্রন করেও তিনি এই অনুশাসনের কোনও উল্লেখ পাননি। ভূপেন্দ্রনাথ বলেন, এরপরই তিনি ‘একটি শ্লোকে ভেজাল আমদানি করলেন’। ঋগবেদের যে শ্লোকটিকে বদলে দেন রঘুনন্দন, সেটির অর্থ ছিল, ‘হে সমবেত সুবেশা রমণীগণ, তোমরা সম্মুখস্থ কক্ষে প্রবেশ করো।’ ভূপেন্দ্রনাথ লিখছেন, “রঘুনন্দন এই শ্লোকটিকে জাল করে লিখলেন হে রমণীগণ তোমরা সম্মুখস্থ অগ্নিকক্ষে অর্থাৎ চিতায় প্রবেশ করো।” অবশ্য অশ্বত্থামা হত ইতি গজ করে তিনি জুড়ে দয়েছিলেন যে, যাঁরা স্বেচ্ছায় এ কাজ করতে চাইবেন, তাঁরাই চিতায় প্রবেশ করবেন। কিন্তু এক্ষেত্রে রমণীগণের ইচ্ছার যে কোনও গুরুত্বই ছিল না এবং এর যে কী ভয়াবহ পরিণাম হয়েছিল, ইতিহাস তার সাক্ষী আছে।
আরও শুনুন: মতবিরোধ সত্ত্বেও সৌজন্য, সত্যজিৎ-মৃণাল সম্পর্ক দিশা দেখায় ‘দিকভ্রষ্ট’ বাঙালিকে
ঠিক এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই ইতিহাসের অভিমুখ বদলে দিয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায়। কুসংস্কার, ভ্রান্ত ব্যাখ্যা, গোঁড়ামি এবং ব্রাহ্মণ্যবাদ তথা পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। গোঁড়ামির হাত থেকে উদ্ধার করে ধর্মের প্রকৃত সত্যরূপ তিনি খুঁজতে চাইছিলেন। আর সে জন্য পাথেয় করেছিলেন শাস্ত্রকেই। প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলি তিনি যে শুধু নিজে পড়তেন তা নয়, অনেকে যাতে পড়তে পারেন সেই ব্যবস্থাও করছিলেন। এই পাঠের প্রসার যত বাড়ছিল, ততই শাস্ত্রের ভুল ব্যাখ্যা বা মিথ্যে ব্যাখ্যার স্বরূপগুলি স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। যার ফলশ্রুতি হিসাবেই একসময় সতীদাহের মতো নিকৃষ্ট প্রথা রোধ করা সম্ভব হয়।
সেদিন যে নবজাগরণ সম্ভব হয়েছিল, বলা যায় রামমোহনের এই যুক্তিনিষ্ঠ শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার দরুনই এই আলোক অভিমুখে যাত্রা সম্ভব হয়ে উঠেছিল। রামমোহন ধর্মের বিরোধিতা করেননি, করেছিলেন ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধিতা। শাস্ত্রের বিবিধ পাঠ উদ্ধার করেই তিনি দেখাতে শুরু করেছিলেন শাস্ত্রের অপব্যাখ্যা। প্রাচীন শাস্ত্র বহুক্ষেত্রেই নারীদের প্রতি ছিল উদার। টীকাকারদের ভুল ব্যাখ্যার দরুনই তাঁদের পদে পদে নানা দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয়। মৃত্যুঞ্জয়াচার্যের ‘বজ্রসূচী’ গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ করেন রামমোহন, যা ছিল জাতিভেদ এবং ব্রাহ্মণ্যপ্রথার বিরুদ্ধে আক্রমণ।
আর তাই, আজ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যখন সংস্কার ও গোঁড়ামি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, তখন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন ভারত-পথিক রাজা রামমোহন রায় এবং তাঁর দর্শন।