ঘাতক ট্রাম এসে কেড়ে নিয়ে গেছে মহাজীবনের কবিকে। তবু যেন ‘জীবনের কিনার ঘেঁষে মৃত্যুর অশরীরের অস্পষ্ট গন্ধের ভিতর’ জন্ম নেয় নতুন গল্প। মনে হয় স্বপ্নের ভিতর অক্ষত হেঁটে আসছেন জীবনানন্দ দাশ।
তাহলে ধরা যাক, সেদিনের সেই ট্রাম আসলে আসেইনি। লিখছেন বিশ্বদীপ দে।
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
কোন সুদূর কুয়াশার ভিতর থেকে তুমি এসেছিলে, হে ট্রাম?
অবশ্য আমরা জানি, সেই বিকেলে কলকাতার রাজপথে কোনও কুয়াশা থাকার কথা নয়। ছিলও না। তবু… আপনমনে পথ হাঁটতে থাকা মানুষটার সামনে বুঝি কুয়াশার শরীর নিয়েই হাজির হয়েছিলে তুমি, যেভাবে অতর্কিতে হানা দেয় ঘাতক, পূর্বপ্রস্তুতির সুযোগটুকুও না দিয়ে!
কিন্তু, তুমি তো সত্যি সত্যি আঘাত করতে পারোনি তাঁকে। তাই, প্রতিটি ১৭ ফেব্রুয়ারি নতুন করে জন্ম নেন জীবনানন্দ দাশ। সত্তর বছর আগের এক করুণ বিকেল যতবার পুনরাবৃত্ত হয়, ততবারই অতিকায় বালিঘড়ি থেকে ঝরে পড়েও ফের উলটো পথে হাঁটে বালি। বাড়ি ফেরেন জীবনানন্দ। আর ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় ধর্মতলা থেকে বালিগঞ্জের দিকে যেতে থাকা ২৪ নম্বর রুটের BOG 304 ট্রামটি।
জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘শেষ ট্রাম মুছে গেছে, শেষ শব্দ, কলকাতা এখন/ জীবনের জগতের প্রকৃতির অন্তিম নিশীথ’… সেই তিনিই লিখেছিলেন ‘আদিম সর্পিণী সহোদরার মতো’ ছড়িয়ে থাকা ট্রামলাইনের কথা। লিখেছিলেন ‘সমস্ত শরীরের রক্তে এদের বিষাক্ত বিস্বাদ স্পর্শ অনুভব ক’রে হাঁটছি আমি।’ আরও আশ্চর্যের, বহুকাল আগে কলকাতার এক বোর্ডিংয়ের ঘরে নিজের ডায়রিতে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন, কেমন করে কেউ ট্রামে চাপা পড়তে পারে! পড়তে পড়তে চমকে উঠতে হয়। নিজেরই ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন তিনি? স্বপ্নের ভিতরে, বিষাদের অন্তর্জগৎ থেকে ভেসে আসা এক যানের সঙ্গে সেই থেকে সম্মুখ সমর তাঁর? নাকি আরও আগে… চেতনার উন্মেষ ঘটার পর থেকেই তোমার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি, হে ট্রাম?
-: আরও শুনুন :-
মন থেকে মনে আলো জ্বেলে চলেছেন যে নিঃশব্দ শব্দসাধক
কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখেছিলেন ‘একটা জাহাজ ছেড়ে গেল’… আমরা জানি, কবি কোত্থাও যাননি। তিনি আছেন। ওই পথ হাঁটছেন তিনি। দূর থেকে তাঁর ধূসর সিলুয়েটের দিকে তাকিয়ে থাকে বাংলা কবিতা। কবি রাস্তা পেরোচ্ছেন জলখাবার ও জুয়েল হাউসের সামনে দিয়ে। ড্রাইভার অনর্গল ঘণ্টা বাজাচ্ছেন। চিৎকারও করছেন! কিন্তু তিনি সরলেন না। তবু, তুমি তাকে মারতে পারোনি, ট্রাম। মন্থরগতির এক যান হয়েও সেদিন ক্ষিপ্র ইগলের মতো এগিয়ে আসা তোমার শরীর আসলে ছুঁতেই পারেনি কবিকে। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ঝকঝকে শানিত ফলার মতো ট্রামলাইনের সামনেই ছিলেন তিনি। দেখছিলেন ট্রামলাইনের চারধার ঘিরে থাকা সবুজ ঘাসেদের। যে ঘাস আজ কংক্রিটের গ্রাসে চলে গেছে বহু বছর হল! উদাসীন মানুষটির দুই হাতে নাকি ধরা ছিল ডাব! আবার কেউ কেউ বলেন, ‘অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা’য় ক্লান্ত হয়ে আত্মহত্যা করতেই চেয়েছিলেন জীবনানন্দ? ‘মরিবার হল তার সাধ’? কী করে তা সম্ভব? ছেলে রঞ্জুর জন্য কেনা ডাব হাতে নিয়ে ট্রামের সামনে স্বেচ্ছায় শরীর পেতে দিয়ে কেউ চলে যেতে চাইতে পারে?
‘যেদিন আমি পৃথিবীর থেকে চলে যাব- হে শঙ্খমালা- অপরিসীম নক্ষত্র তুমি বিছিয়ে রেখো আকাশে’ – এই এপিটাফ মেনে নিতে রাজি নই আমরা কেউ। তাই এই শহরের দূষণে লুকিয়ে ফেলেছি সমস্ত নক্ষত্রপ্রতিম অনিবার্যতা। আততায়ী ট্রাম প্রতিটি বিকেলের রোদ্দুরে ফিরে ফিরে আসে। ফিরে যায়। ব্যর্থ হয়েই। একদিন হয়তো এই শহরের বুকে আর কোনও ট্রাম চলবে না। তবু তোমার প্রেত ঘুরেফিরে আসবে, হে ট্রাম! উইলিয়াম ফকনার লিখেছিলেন ‘দ্য পাস্ট ইজ নট ডেড। ইন ফ্যাক্ট, ইটস নট ইভেন পাস্ট।’ অতীত মৃত নয়। এমনকী, তা অতীতও নয়। জীবনানন্দও তো জানতেন ‘জীবনের কিনার ঘেঁষে মৃত্যুর অশরীরের অস্পষ্ট গন্ধের ভিতর’ জন্ম নেওয়া গল্পের কথা। একের পর এক সমান্তরাল মহাবিশ্বে তাই হেঁটে হেঁটে চলে যান জীবনানন্দ। তোমার সাধ্যও নেই তাঁকে ছোঁয়ার, হে অসহায় আততায়ী।
বাংলা কবিতার আবহমান পাঠকের স্বপ্নের ভেতর আজও বাড়ি ফেরেন জীবনানন্দ দাশ। শেষ মুহূর্তে ট্রামের কবল থেকে বেঁচে। বহু বছর আগে ট্রামের ক্যাচারে আটকে যাওয়া তাঁর রক্তাক্ত শরীর এত বছর পরেও তাই স্বপ্নের ভিতর অক্ষত। ঠিক তাঁর আবহমান কবিতাগুলির মতোই।