তিনি নাগরিক কবিয়াল। রেডিও আর টেপরেকর্ডারের সাদাকালো যুগে ধূমকেতুর মতোই উঠে এসেছিলেন তিনি। গিটার হাতে সেই উদ্ধত যুবকের মুখে কলকাতা শুনেছিল ভালবাসার গভীরতম উচ্চারণ, ‘তোমাকে চাই’। তিনি সুমন চট্টোপাধ্যায়, পরবর্তীতে কবীর সুমন। নাগরিক বাঙালির নিজের ভাষাকে গানের শরীর দিয়েছিলেন সুমন। তাঁর হাত ধরেই নগরের গায়ে গায়ে লেগে থাকা সুখ-দুঃখ-হতাশা আর নাগরিক ক্লান্তিকে চিনেছে বাঙালি। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত সুমন যেন এক অনবদ্য সংক্রমণ। এমন এক অব্যর্থ উচ্চারণ যার কাছে বাঙালির ফিরে ফিরে আসা। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে সেই অমোঘ সুমনেই ডুব দিলেন সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সময়টা ১৯৯২ সাল। মার্চ কি এপ্রিল মাস- আমার বাবার এক ছাত্র একটা নীল রঙের অডিও ক্যাসেট নিয়ে হঠাৎ বাড়িতে এসে হাজির হয়। সেটা নাকি নতুন বেরিয়েছে, এবং গানগুলো একদম অন্যরকম। আমিও ক্যাসেটটি হাতে নিয়ে দেখলাম। উপরে লেখা রয়েছে- ‘সুমনের গান তোমাকে চাই’। সঙ্গে একটা ছবিও রয়েছে। নীল জামা পরা একজন মানুষের, হাতে গিটার। আবছায়ার মধ্যে রয়েছেন তিনি। তাঁকে যে কেমন দেখতে তা ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। সেই মুহূর্তে মনে পড়ল, আমার ক্লাস ইলেভেনে পড়া দাদাও যেন এঁর কথাই বলছিল। সেও শুনেছে যে, কে একজন সুমন চট্টোপাধ্যায় দারুণ গান গাইছেন। চারিদিকে নাকি হইচই পড়ে গিয়েছে। কলেজ সোশ্যালগুলোতে নাকি একটা গিটার নিয়ে লোকটা আসছেন, তিন ঘন্টা একেবারে মাতিয়ে দিচ্ছেন। ক-দিন আগে বাবার এক বন্ধু এসেও সুমনের গানের কথা বলছিলেন। বাবাও বলল, শুনতে হবে তো! এসবের মাঝখানেই বাবার এই ছাত্রের আগমন, একেবারে অডিও ক্যাসেট হাতে নিয়ে। আমার মনে আছে, সেদিন আমার দাদা বাড়িতে ছিল না। বাড়িতে শুধু আমি, বাবা, মা, এবং বাবার সেই ছাত্র। ক্যাসেট চড়ানো হল টেপ রেকর্ডারে। মনে আছে, প্রথমে চাপানো হয়েছিল B পিঠটি। কেননা ইতিমধ্যেই বহুবার সেদিকটা চালানো হয়েছে। B পিঠের প্রথম গানটার পর থেকে শুরু হল গান- ‘একমুখ দাড়ি গোঁফ, অনেক কালের কালো ছোপ ছোপ, জটপড়া চুলে তার উকুনের পরিপাটি সংসার।’ আমাদের এতদিনের গান শোনার অভ্যাসের, বলা যায় একটা নির্দিষ্ট ধরন ছিল; এক ধরনের স্থবির যাপন যেন আমাদের গ্রাস করেছিল জট পড়া চুলে উকুনের সংসারের মতোই। কে যেন আমাদের পরিশ্রুত জলে স্নান করিয়ে দিতে লাগলেন ক্রমাগত। এবং আমাদের মাথার সেই উকুনের জট ছাড়িয়ে দিতে লাগলেন। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি! আমি তখন কিশোর। এত বিশদ ব্যাখ্যার ক্ষমতা তখন ছিল না। শুধু ভিতর ভিতর কী একটা হচ্ছিল। আর লক্ষ্য করছিলাম বাবা ও মায়ের মুখ। গানের এক একেকটা বাঁকে, এক একটা উপমায় ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ওদের মুখ।
শেষ হল ‘পাগল’। কারও মুখে কোনও কথা নেই। শুরু হল ‘চেনা দুঃখ চেনা সুখ’। ক্রমে চলে এল ‘গড়িয়াহাটার মোড়… মিনি মিনি বাস বাস’। একসময় ‘আমাদের জন্য’ গানটিও শেষ হল। বাবা বিড়বিড় করে বলল, এ তো টি এস এলিয়ট। অবজেক্টিভ অ্যান্ট কো-রিলেটিভ- অর্থাৎ, বিভিন্ন চিত্রকল্প যা আপাতদৃষ্টিতে সংযোগ ও সম্পর্কহীন, সেইগুলো পরপর সাজিয়ে আর একটা বিষয়কে তুলে ধরা। এ তো বড় সহজ কথা নয়। A পিঠ শোনার আগেই ক্যাসেটের ইনলে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল বাবা। আমার মনে আছে, ‘তোমাকে চাই’ ক্যাসেটের প্রত্যেক গান কী নিয়ে লেখা, কেন লেখা তার বিবরণ লেখা ছিল ইংরেজিতে। এবং আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লেখা ছিল, যা বাংলা গানের ইতিহাস এবং সারা পৃথিবীর গানের ইতিহাসে বিরলতম বলা যায়। কথা-সুর-কণ্ঠ ও যন্ত্রানুষঙ্গ- সুমন চট্টোপাধ্যায়। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, গানের সঙ্গে শুধুমাত্র গিটার বাজছে না। সেখানে অনেকগুলো গানে আছে পুরোদস্তুর অর্কেস্ট্রেশন। যা কিনা একজনের বাজানো, একজনের মস্তিষ্কপ্রসূত এবং নির্মিত। এ তো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার! এই ব্যাপারটা হজম করতে মাছেভাতে বাঙালির বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল। সে তো পরের গল্প। আপাতত ক্যাসেটের A পিঠ চালানো হল। শুরু হল ‘তোমাকে চাই, তারপর ‘পেটকাঠি চাঁদিয়াল’, তারপর ‘তুই হেসে উঠলে’… একের পর এক গান। একের পর এক বিস্ফোরণ।
এরপর যেন শুরু হল উৎসব। একটা অডিও ক্যাসেট বারবার চালানো, সমমনস্ক বন্ধু, সহকর্মী, স্কুলের কিংবা পাড়ার বন্ধু – সবাইকে ডেকে ডেকে গান শোনানো। নতুন গান। নতুন বাংলা আধুনিক গান। এ শুধু আমাদের বাড়ির অভিজ্ঞতা নয় কিন্তু। কলকাতা এবং শহরতলীতে তখন সংক্রমণের মতো ছড়িয়ে পড়েছেন সুমন। ছড়িয়ে পড়েছে ‘তোমাকে চাই’। সত্যজিৎ রায় প্রয়াত হন ২৩ এপ্রিল, ১৯৯২ সালে। ঠিক তার পরের দিন সম্ভবত তোমাকে চাই-এর মাত্র একটি বিজ্ঞপনই সংবাদপত্রে বেরিয়েছিল। বিজ্ঞাপন নয়, সুমন ছড়িয়ে পরেছিলেন জনশ্রুতির মাধ্যমে। হাত থেকে হাতে, বুক থেকে বুকে নিষিদ্ধ ইশতেহারের মতোই- যা এই উপমহাদেশের সংগীত বলয়ে একটি বিরলতম ঘটনা হয়েই থেকে যাবে। কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে, শান্তিনিকেতন, সর্বত্র তখন সুমনকে নিয়ে উন্মাদনা। এক নতুন বাংলা গানের কারিগরকে নিয়ে উন্মাদনা। যাঁর গানের বিষয় হিসাবে উঠে এসেছে ফুটপাথের পাগল থেকে বস্তির দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরের মানুষের যৌনতা-প্রেম, কিংবা কলকাতার তিনশো বছরের ইতিহাসের বৃত্তান্ত- সবকিছুই। এই উন্মাদনাকে চাক্ষুষ করাও এক পরম পাওয়া।
এবার আসি পারফরমেন্সের কথায়। একটা মঞ্চ জুড়ে একজন মাত্র মানুষ এদিক থেকে ওদিক দৌড়ে চলে যাচ্ছেন। একদিকে রয়েছে দুটি কি-বোর্ড, সিন্থেসাইজার; অন্যদিকে রয়েছে গিটার। ইলেক্ট্রনিক কি-বোর্ড বাজিয়ে গান করছেন, আর ডান দিকে ঘুরে পাশের সিন্থেসাইজারে বাজাচ্ছেন ইন্টারল্যুড এবং প্রিল্যুড। গান শেষ হতে না হতেই দৌড়ে যাচ্ছেন ডান দিকে। মাউথ অর্গ্যান আর গিটার বাজিয়ে শুরু করছেন আর একটা নতুন গান। কখনও তার ফাঁকে বলে উঠছে প্রাবন্ধিক এজরা পাউন্ডের কথা। দর্শকাসন থেকে বারবার অনুরোধ আসছে- নতুন গান, সুমনদা, আর একটা নতুন গান…। হ্যাঁ, নতুন বাংলা গান নিয়ে এমন উন্মাদনা আমাদের পরপর কয়েকটা প্রজন্মকে এমন অভিঘাত দিয়েছে যে আমরা স্বপ্ন দেখা ছাড়তে পারিনি। আমরা ভিন্ন উচ্চারণে তাই বলে উঠেছি,- ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ব্যারিকেড করো প্রেমের পদ্যটাই… বিদ্রোহ আর চুমুর দিব্যি শুধু সুমনকেই চাই।