শঙ্খ ঘোষ তাঁর জীবনের মধ্যপথে এসে অতিরিক্ত কথা না-বলার, শব্দহীন হওয়ার যে-সাধনা শুরু করেছিলেন, সেই সাধনা থেকে তিনি শেষ বয়স পর্যন্ত বিচ্যুত হননি। মুখে-বলা শব্দ নয়, তিনি নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন তাঁর লেখার ভেতর। সেইখানে সাদা পৃষ্ঠার অখণ্ড নীরবতায় ফুটিয়ে গেছেন শব্দনক্ষত্র।
জন্মদিনে সেই নিঃশব্দ শব্দসাধক-কে স্মরণ করলেন সৌভিক গুহসরকার।
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
‘এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো
শব্দহীন হও’
শঙ্খ ঘোষের ‘মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘আয়ু’ নামক এই প্রসিদ্ধ কবিতাটির রচনাকাল ১৯৭২-৭৩ সাল নাগাদ। কাব্যগ্ৰন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। শঙ্খ ঘোষের বয়স তখন ৫২। এই কবিতাটি যখন লিখছেন, তখন সবে পঞ্চাশ-একান্নতে ঢুকছেন শঙ্খ। এই সময়তেই তাঁর ‘মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়’ নামক কবিতায় পাচ্ছি—
‘ঘরে ফিরে মনে হয় বড়ো বেশি কথা বলা হলো?
চতুরতা, ক্লান্ত লাগে খুব?’
শঙ্খ ঘোষ তাঁর জীবনের মধ্যপথে এসে অতিরিক্ত কথা না-বলার, শব্দহীন হওয়ার যে-সাধনা শুরু করেছিলেন, সেই সাধনা থেকে তিনি শেষ বয়স পর্যন্ত বিচ্যুত হননি। মুখে-বলা শব্দ নয়, তিনি নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন তাঁর লেখার ভেতর। সেইখানে সাদা পৃষ্ঠার অখণ্ড নীরবতায় ফুটিয়ে গেছেন শব্দনক্ষত্র। আমি তাঁকে নানা অনুষ্ঠানে নীরব থাকতে দেখেছি। তিনি রয়েছেন মঞ্চে। বিভিন্ন বক্তারা কথা বলছেন, কবিরা কবিতা পড়ছেন। কিন্তু তিনি এক শ্বেত নীরবতায় ডুবে রয়েছেন। একাকী। সবার কথা শুনছেন উৎসুক হয়ে। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত থাকছেন। কিন্তু কথা বলছেন না একটিও। কথার মধ্যে চতুরতা থাকে— এটি অনুভব করার পর থেকেই কি প্রকাশ্য মঞ্চে কথা বলা থেকে সরিয়ে নিলেন নিজেকে ক্রমশ? আমি তাঁকে বেশ কয়েকবার রোববারের আড্ডাতেও দেখেছি। তাঁকে ঘিরে কথা চলছে। নানা মানুষ নানা কথা বলছেন। তিনি মৃদু হাসছেন। শুনছেন। কেউ কাছে গিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর দিচ্ছেন। কিন্তু তিনি আলাদা করে কিছু বলছেন না। তাঁর পথে নামা, কোনো সভায় তাঁর উপস্থিতি, লিখিত প্রতিবাদ— তাঁর মনোভাব বুঝিয়ে দিচ্ছে। নিজেকে নিজের ভেতর টেনে রেখেও, সমস্ত সামাজিক তরলতা বর্জন করেও সমাজ ও পৃথিবীর সঙ্গে তাঁর নিরন্তর যোগাযোগের শান্ত নীরব পদ্ধতিটি আমাদের অনেক কিছু বলে যায়। শুধু একটিবার কৃত্তিবাস উৎসবে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে তিনি নিজে আচমকা উঠে বেশ খানিকক্ষণ কথা বলেছিলেন। যিনি সচরাচর কোনো মঞ্চে কথা বলেন না, তিনি সেইদিন কথা বললেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে। কৃত্তিবাস নিয়ে। তাঁর প্রথম কবিতার বই নিয়ে। সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা আমাদের সকলের।
মনে পড়ে তাঁকে গিয়ে মাঝেমধ্যে নানা প্রশ্ন করেছি। তিনি প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ধীরস্থির ভাবে। চিন্তা করে। দু’এক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত কৌতূহল মেটাতে জিজ্ঞেস করে ফেলেছি রবীন্দ্রনাথের ক্রোধের বিষয়ে— ‘রবীন্দ্রনাথ কি খুব রাগী ছিলেন?’ তিনি বলেছেন, ‘হ্যাঁ। খুব—’। জিজ্ঞেস করেছি, ‘বিদ্যাসাগর এত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন কেন?’ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘ওঁকে রাগিয়ে দেওয়া হত।’
এইখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি। আমার পিতামহ সমরেন্দ্রকৃষ্ণ সরকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ পড়াকালীন ১৯৩৮ সালে ‘ডালি’ নামক একটি হাতে-লেখা পত্রিকা প্রকাশ করেন। সেই পত্রিকায় রয়েছে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি প্রসিদ্ধ মানুষদের হাতে লেখা বাণী। একসময়ে সেই পত্রিকা পৌঁছয় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের হাতে এবং তিনি নিজে হাতে একটি চার লাইনের কবিতাও লিখে দেন—
‘চিত্রকলা সাথে করো
সাহিত্যের মিলনসাধনা
লেখনীর লীলারঙ্গে
সুন্দর লভুক অভ্যর্থনা।’
এই হাতে-লেখা পত্রিকাটি নিয়ে আমি সে সময় কাজ করছিলুম, কিন্তু খুব বেশি তথ্য জোগাড় করে উঠতে পারিনি কারণ বাংলার হাতে-লেখা পত্রিকা নিয়ে ইতিপূর্বে কোনও কাজ হয়নি। তার ফলে খাপছাড়া কিছু তথ্য সংগ্ৰহ করছিলুম। বাংলায় হাতে-লেখা পত্রিকার শুরু কবে, কেনই বা হাতে-লেখা পত্রিকা শুরু হল, কারা কারা হাতে-লেখা পত্রিকা রচনা করেছেন, এসব বিষয়ে বেশ খানিকটা অন্ধকারে ছিলুম। একদিন কথাপ্রসঙ্গে শঙ্খ ঘোষকে সে কথা আমি জানাই।
উনি শুনলেন শুধু। একটিও কথা বললেন না।
পরে এক রোববার গেছি। উনি উঠে গেলেন ভেতরের ঘরে। হাতে করে একটি বই নিয়ে বেরিয়ে এলেন। বইটি মন্মথনাথ ঘোষের ‘সেকালের লোক’। তিনি একটি পাতা খুলে বললেন, ‘এটা পড়ো।’ পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখলুম লেখা রয়েছে যে কৈলাসচন্দ্র বসু ১৮৪০ নাগাদ ইস্কুলে পড়াকালীন একটি হাতে-লেখা পত্রিকার কথা জানিয়েছেন। আমি স্তম্ভিত। শঙ্খ ঘোষের মুখে মৃদু হাসির রেখা। তিনি বললেন, ‘তুমি শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে খোঁজ করো। আমি ওখানে ছাত্রদের হাতে-লেখা পত্রিকা দেখেছি’। ছুটলুম শান্তিনিকেতনে। অনেক পরিশ্রমের শেষে সেসব পাওয়া গেল। পরবর্তীকালে যখন ডালির ফ্যাকসিমিলি-সহ পূর্ণাঙ্গ লেখাটি প্রকাশিত হল, তখন একটি কপি ওঁকে দিতে গিয়েছিলুম। ওঁর স্নিগ্ধ হাস্যোজ্জ্বল মুখটি আমি এখনও দেখতে পাই।
অতিরিক্ত কথা নেই। কথার আড়ম্বর নেই। আতিশয্য নেই। অথচ সাহায্য রয়েছে, স্নেহ রয়েছে, আলো রয়েছে।
একবার জিজ্ঞেস করেছিলুম, ‘মাল্যবানের অবকল্পনা ছিল— এটার কী মানে?’
উনি বললেন, ‘তোমার কী মনে হয়?’
আমার কাছে খুব স্পষ্ট কোনো উত্তর ছিল না সে সময়। বললুম, ‘কল্পনার তলা? কল্পনার তলার কোনো স্তর—এইরকম কিছু?’
উনি চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ।
তারপর শান্ত গলায় বললেন, ‘তলার কল্পনা, তলিয়ে ভাবতে পারার ক্ষমতা—’
এক মুহূর্তে সমস্ত দ্যোতনা নিয়ে খুলে গেল অবকল্পনা শব্দটির অর্থ।
আমি দেখলুম শব্দহীনতা আর কথার মাঝখানে এক নিজস্ব গোধূলিতে বিচরণ করে মন থেকে মনে আলো জ্বেলে চলেছেন শঙ্খ ঘোষ।