‘যা লেখা হচ্ছে তাই পড়া, আর যা পড়া হচ্ছে তাই লেখা হচ্ছে- এরকম একটা পাকচক্র সাহিত্যের পক্ষে ভালো নয়। লেখককে প্রত্যাখ্যান করার শক্তি ও অধিকার পাঠকের না থাকলে, পাঠক, পাঠক হন না। আর পাঠককে প্রত্যাখ্যান করার শক্তি ও অধিকার লেখকের না থাকলে, লেখক, লেখক হতে পারেন না।’ বলেছিলেন দেবেশ রায়।
শঙ্খ ঘোষের দেওয়া অভিধা অনুসরণ করে বলা যায়, তিনি বাংলা ভাষার ‘শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক’। যথার্থ এই উক্তি। তবে দেবেশ রায়কে নিয়ে মুশকিল এই যে, কেবল একটি অভিধাতেই তাঁকে সীমায়িত করাও সম্ভব নয়। সন্দেহাতীত ভাবে বাংলা উপন্যাসের ধ্রুপদীয়ানায়, গঠন-ধরন-বিন্যাসের নিরিখে তিনি শ্রেষ্ঠ শিল্পী, আবার একই সঙ্গে তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার, প্রাবন্ধিকও বটে। এই পর্যন্ত বললেও অবশ্য দেবেশ রায়কে সার্থক ভাবে ধরা যায় না। বাংলা উপন্যাসের কিংবা আর-একটু প্রসারিত অর্থে বাংলা ভাষায় রচিত আখ্যানের তত্ত্ববিশ্ব নিয়ে তাঁর যে নিরন্তর ভাবনা, তা তিনি প্রকাশ করেছেন বহুবিধ উপায়ে। প্রবন্ধ তো আছেই, আছে সেই সংক্রান্ত বইও; তার পাশাপাশি কখনও সাক্ষাৎকার, কখনও অন্য কোনও বইয়ের আলোচনা- এমন বহু গোত্রের লেখায় একটু একটু করে তিনি যেন নির্মাণ করেছেন তাঁর চিন্তাবিশ্ব। ফলত দেবেশ রায় নামে এক মহালেখককে যদি অনুভব করতে হয়, তবে সমস্তরকম অভিধা পেরিয়ে তাঁকে স্পর্শ করতে হবে বিস্তারের ব্যঞ্জনায়। দেবেশ রায় প্রয়াত হয়েছেন প্রায় বছর দুয়েক। দেরিতে হলেও, এতদিনে দেবেশের বিস্তার স্পর্শ করার প্রয়াসে অনুষ্ঠিত এক মেধাবী ভাবনা-বিনিময় তথা কথোপকথনের সাক্ষী থাকল বাঙালি পাঠক। ১৭ জুলাই, ‘কেতাব-e’ প্রকাশনার আয়োজনে রোটারি সদনে হল সেই অনুষ্ঠান।
আরও শুনুন: মতবিরোধ সত্ত্বেও সৌজন্য, সত্যজিৎ-মৃণাল সম্পর্ক দিশা দেখায় ‘দিকভ্রষ্ট’ বাঙালিকে
দেবেশ রায় সেই বিরল গোত্রের লেখক, যিনি রুশতী সেনকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘যা লেখা হচ্ছে তাই পড়া, আর যা পড়া হচ্ছে তাই লেখা হচ্ছে- এরকম একটা পাকচক্র সাহিত্যের পক্ষে ভালো নয়। লেখককে প্রত্যাখ্যান করার শক্তি ও অধিকার পাঠকের না থাকলে, পাঠক, পাঠক হন না। আর পাঠককে প্রত্যাখ্যান করার শক্তি ও অধিকার লেখকের না থাকলে, লেখক, লেখক হতে পারেন না।’ রুশতী সেন স্বয়ং এই অনুষ্ঠানে দেবেশ রায়কে দেখার চেষ্টা করলেন প্রত্যাখ্যানের দৃষ্টিকোণ থেকে। লেখক দেবেশের প্রত্যাখ্যান, তাঁর চরিত্রদের প্রত্যাখ্যান- একরকমের রাজনৈতিক প্রস্তাবের জন্ম দেয়। যে-প্রস্তাব কেবল দলীয় নয়। আবার একই সময়ে দেবেশের রচিত বিভিন্ন চরিত্রদের মধ্যে গতায়াতের সম্ভাবনা যদি খতিয়ে দেখা যায়, তবে দেবেশের উপন্যাস থেকে উপন্যাসে, আখ্যান, প্রত্যাখ্যানের অবলম্বনে এক বহুমাত্রিক বিস্তার লাভ করে। এই বিস্তার চমকে দেওয়ার মতো, ভাবীকালের পাঠককে নিশিচতই তা অন্যতর সত্যের দিকে ধাবিত হতে প্ররোচিত করবে। সত্যের কোনও নির্দিষ্ট কাঠামোয় যে দেবেশের স্থির বিশ্বাস ছিল না, সে-কথা ধরিয়ে দিলেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ও। সম্ভাবনার সত্যিকে, কেন্দ্র থেকে পরিধির দিকে দেবেশের বিস্তারকে তুলে আনলেন তিনি। গৌতম সেনগুপ্ত যেমন বললেন, দেবেশের আর-এক বিস্তারের কথা। একজন লেখক নিজেকে পুনরাবৃত্ত করেন না ঠিকই, তবু কিছু কিছু জলছাপ অক্ষরের গায়ে তো থেকেই যায়। দেবেশ তাঁর গল্পে যেমন হুলস্থূল বাধিয়ে দিয়েছিলেন, তরুণের গল্পপাঠের অভ্যস্ত ছককে ভেঙে দিচ্ছিলেন, তেমনই ভাঙছিলেন নিজেকেও। এক লেখা থেকে অন্য লেখায়- কী আঙ্গিকে কী ভাষায় কী অভিব্যক্তিতে- নিজেকে সম্পূর্ণ অচেনা করে তুলছিলেন তিনি। এইটেই পাঠকের সঙ্গে দেবেশের মোকাবিলা; সমকাল এবং ভাবীকালের সঙ্গেও। স্বপন পাণ্ডা তাই বলেন, দেবেশ নিজেকে এমন এক মহালেখকের উচ্চতায় আসীন করেছেন, যাঁকে বাঙালি পাঠক যদি ভুলক্রমে বলে ফেলেন পড়েননি, তো লজ্জিত হবেন। এপিকের মতোই দেবেশ-পাঠ আবশ্যকীয়, জরুরি এবং অনিবার্য।
আরও শুনুন: গীতাঞ্জলি শ্রী-র হাত ধরে প্রথম বুকার পুরস্কার পেল ভারতীয় ভাষা
দেবেশ রায়ের মতো একজন লেখকের কলম থেমে যাওয়া গভীর শূন্যতার জন্ম দেয়, এ-কথা নতুন নয়। কিন্তু সেই শূন্যতা ঠিক কতখানি, তা অনুভব করা সম্ভব, দেবেশকে পুনর্বার পাঠের আয়োজনে। হতে পারে তা শুধু তাঁর গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি আঙ্গিকে লেখাগুলির পাঠ। আবার আর-একটু সম্প্রসারিত অর্থে, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, টুকরো কথা, এমনকী বই পর্যালোচনা- এই সবকিছু নিয়ে সামগ্রিক ভাবে পাঠ করা যেতে পারে তাঁকে। তাঁর চিন্তাবিশ্বের নকশাখানা তাতে অনেকটা স্পষ্ট হয়। বাঙালি পাঠকের সেই অভিপ্রায় পূরণ করতেই এদিন দুটি বই প্রকাশিত হল। একটি দেবেশ রায়ের সাক্ষাৎকারের সংকলন ‘চাপান-ওতোর’, অন্যটি তাঁর বিভিন্ন গোত্রের লেখার সংকলন ‘পড়া-দেখা-শোনা’। দুটি বইয়েরই সম্পাদনার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন সমরেশ রায়। দেবেশবাবুর ভাই পরিচয় সরিয়ে রেখে, শিল্প-সাহিত্যের একজন জিজ্ঞাসু, একজন চিন্তাশীল মানুষ হিসাবেই দেবেশের বিস্তারকে ধরে রাখতে চেয়েছেন বলা যায়। তাই তিনি জানান, ‘একটা কথা উঠতেই পারে সহোদরের রচনা রক্ষার জন্যই কি এই প্রয়াস? একেবারেই ব্যক্তিগত? রচনাগুলো রক্ষা তো একটা দায় বটেই। কিন্তু আমাদের সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক ও চিন্তকের, শিল্পের নানা বিষয়ে লিখিত প্রতিক্রিয়া তো নিজেদের শিক্ষিত করে তোলার জন্যই প্রকাশ প্রয়োজন।’ এই ‘শিক্ষিত’ হয়ে ওঠার অনুশীলনটি যে জারি রয়েছে, তারই সাক্ষ্য দিল এদিনের অনুষ্ঠান। দেবেশ রায়ের নানা গোত্রের লেখাগুলি প্রকাশ ও এমন অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ধন্যবাদার্হ হয়ে থাকল বই প্রকাশনা সংস্থা ‘কেতাব-e’।