‘প্রতিক্ষণ’ মনে করিয়ে দিয়েছে, বিপদে-দুর্যোগে পাশে পাশে থাকা যে সংহতির বার্তা দেয়, তাই-ই আমাদের রক্ষা করতে পারে যাবতীয় দুর্যোগ থেকে। শুধু বইপাড়া নয়, সেই মূল বার্তাটুকু ছড়িয়ে পড়ে সমাজের সর্বত্রই। বই দু-মলাটে বাঁধা, তবু বই-ই তো আমাদের মনকে মুক্ত করে। মুক্তচিন্তার সেই ডাক তাই যেন উঠে এল বইপাড়া থেকেই। হ্যাঁ, হাতে হাত রেখে বেঁধে বেঁধে থাকা সহজ নয়। তবে, তা যদি যাপনের অংশ করে নেওয়া যায়, তবে তার থেকে ভালো আর কিছু হয় না।
প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত, ‘প্রতিক্ষণ’। যে বইপাড়া প্রতিদিন পাতায় পাতায় চালাচালি হয় বন্ধুতার অক্ষর, বিপর্যয়ের দিনে তা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেই বা কী করে! অতএব ‘প্রতিক্ষণ’। রেমাল ঝড়ের অশনিসংকেতের মাঝেই হাতে হাত রাখার ডাক দিল কলেজ স্ট্রিটের ঐতিহ্যবাহী এই প্রকাশন। ঝড়ের দিনে অনেক বইবিপণিরই ঠিকানা হয়ে উঠতে পারে প্রতিক্ষণ বইচাঘর। কলেজ স্ট্রিট, বিশেষত সূর্য সেন স্ট্রিট সংলগ্ন এলাকায় জল জমার সমস্যা দীর্ঘদিনের। ফলে বড় দুর্যোগ এলে বিপদে পড়েন বিক্রেতারা। বইয়ের স্টক কোথায় নিরাপদে রাখা যায়, তাই-ই চিন্তার বিষয় হয়ে ওঠে। সেই পরিস্থিতিতেই বইচাঘর-এর দোতলায় বইবিপণিগুলিকে বই রেখে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ‘প্রতিক্ষণ’।
এর আগে আমফানের সময় এই বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল বইপাড়া। দুর্যোগের দরুণ চারিদিক জল থইথই। যে বিপণিগুলি খানিকটা উঁচুতে সেগুলি তাও রক্ষা পেয়েছিল। বাকিদের প্রায় মাথায় হাত পড়ার অবস্থা। নিচু দোকানগুলিতে জল ঢুকে পড়ার দরুণ বহু বই নষ্ট হয়েছিল। দুর্যোগের পর থেকে সেই ছবি সামনে আসতে শুরু করে। বইপ্রেমীরা তাতে আহত হন। প্রকাশকের আর্থিক ক্ষতি তো বটেই, তবে প্রিয় বই নষ্ট হয়ে যাওয়া কষ্ট দিয়েছিল অনেককেই। তবে এরকম দুর্যোগের সময় কীভাবে বই রক্ষা করা সম্ভব, সেরকম মোকাবিলা ব্যবস্থা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। বিগত কয়েক বছরে সূর্য সেন স্ট্রিট ও সংলগ্ন এলাকায় বইবিপণির সংখ্যা বেড়েছে। বলতে গেলে, নতুন প্রকাশকদের আস্তানা হয়ে উঠেছে এই এলাকা। এখন, রেমাল-এর আশঙ্কা যখন ঘনিয়ে উঠেছে, তখন একই বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছিলেন তাঁরা। কেউ কেউ নিশ্চিত বিকল্প ব্যবস্থারও সন্ধান করছিলেন। তবে, সকলের পক্ষে যে বই অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সেই পরিস্থিতি আঁচ করেই এদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘প্রতিক্ষণ’ প্রকাশনার পক্ষ থেকে রবিবার জানানো হয়, ‘সূর্য সেন স্ট্রিট ও সলগ্ন এলাকার বইবিপণিগুলি – যাঁরা স্থানাভাবের জন্য বইয়ের স্টক নিরাপদ জায়গায় রাখতে পারছেন না, তাঁরা- নিসংকোচে প্রতিক্ষণ বইচাঘরে আজ ও কালকের জন্য তাঁদের স্টক রাখতে পারেন। আমাদের বিপণি দোতলায় হওয়ার কারণে তুলনায় নিরাপদ অবস্থানে রয়েছে।’ সেই ডাক সাড়া ফেলেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। লেখক, বইপ্রেমীরা তো বটেই, অন্য প্রকাশকরাও একযোগে সাধুবাদ জানিয়েছেন এই উদ্যোগকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, অনেকেই ইতিমধ্যে প্রতিক্ষণ-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। বিপণি আছে যাঁদের এবং যাঁরা বই ডেলিভারি করেন, তাঁরা অনেকেই এরকম একটি জায়গার খোঁজ করছিলেন। প্রতিক্ষণ-কে পাশে পেয়ে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা চিন্তামুক্ত। সাত-আটজন ইতিমধ্যেই বই রেখে গিয়েছেন। প্রতিক্ষণ-এর পক্ষ থেকে তা যত্ন করেই তুলে রাখা হয়েছে।
বইপাড়ার অগ্রণী এই প্রকাশনার এই ডাক যেন নতুন করে আর একবার মনে করিয়ে দিল বইপাড়ার বন্ধুতার সংস্কৃতিকে। বিগত প্রায় এক দশকে বইয়ের বিপণনের মাধ্যম অনেক বদলে গিয়েছে। প্রতিযোগিতা বেড়েছে তা নিয়েও কোনও সন্দেহ নেই। তবে, বইপাড়ার সম্পদ যদি কিছু থাকে তাই এই আত্মীয়তা। এক পরিবার হয়ে থাকার বোধ। বইমেলার সময় সে ছবি খানিকটা ধরা পরে বইকি! তারপর বছরভর নিজস্ব ঠিকানায় মাথা গুঁজে থাকা; তবু সকলে মিলে যে একটা যৌথ পরিবারেরই অংশ, এই বোধই বাঁচিয়ে রাখে বইপাড়াকে। অনেকে বলে থাকেন, বই পড়া ক্রমশ কমছে। বাংলা বই বিক্রির বাজারও যে বিপুল, তা বলা যায় না। তার পরেও বহু তরুণ যে প্রকাশনায় আসছেন, তা সবটাই ব্যবসার কারণে নয়। বরং সেখানে পারিবারিকতার টানটাই মুখ্য। প্রায় পরিবারের অভিভাবকের মতোই সেই জায়গাটি এদিন ধরিয়ে দিয়েছে ‘প্রতিক্ষণ’। মনে করিয়ে দিয়েছে, বিপদে-দুর্যোগে পাশে পাশে থাকা যে সংহতির বার্তা দেয়, তাই-ই আমাদের রক্ষা করতে পারে যাবতীয় দুর্যোগ থেকে। শুধু বইপাড়া নয়, সেই মূল বার্তাটুকু ছড়িয়ে পড়ে সমাজের সর্বত্রই। বই দু-মলাটে বাঁধা, তবু বই-ই তো আমাদের মনকে মুক্ত করে। মুক্তচিন্তার সেই ডাক তাই যেন উঠে এল বইপাড়া থেকেই। হ্যাঁ, হাতে হাত রেখে বেঁধে বেঁধে থাকা সহজ নয়। তবে, তা যদি যাপনের অংশ করে নেওয়া যায়, তবে তার থেকে ভালো আর কিছু হয় না।