বাঙালির পয়লা বৈশাখ। পয়লা বৈশাখের বাঙালি। ঠিক আগের মতোই আছে! নাকি পয়লা বৈশাখ নেহাত পোশাকি উদযাপনে এসে ঠেকেছে? তা নিয়েই নিজের ভাবনা জানালেন, শাঁওলি দে।
পড়ে শোনালেন: চৈতালী বক্সী। গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক।
আজও সেসব দিনের কথা মনের ভেতর মাঝেমধ্যেই ঘুরে ফিরে আসে। সাদা সুতির ফুলছাপ টেপজামাগুলোর জন্যই করতাম অপেক্ষা! কখনো বা ফ্রক ছোট হয়ে যেতে, মিলত সুতির জংলি ছাপের জামা। জামাগুলোর গায়ে লেগে থাকা কাঁচা রঙের গন্ধ আজও যেন নাকে লেগে আছে।
একলা বৈশাখ-কে যে কবে থেকে পয়লা বৈশাখ বলতে শিখলাম তা আর মনে পড়ে না। শুধু আবছা মনে পড়ে, মা সংক্রান্তির দু-একদিন আগে বাজারে নিয়ে যেত। বাবা অফিসফেরত নিয়ে আসত, ছোট ছোট ফুল কিংবা পাখির ছবি দেওয়া কার্ড।
পড়া শেষে সেইসব কার্ডে স্কেচ পেন দিয়ে কাঁচা হাতে লিখে দিতাম বন্ধুদের নাম, কখনও বা প্রচলিত ছড়া- ‘ডালে ডালে ফুল ফুটেছে, নববর্ষের ডাক এসেছে, তুমি আমার বন্ধু হও, নববর্ষের কার্ড লও!’
পরের দিকে নিজে হাতেও কত কার্ড বানিয়েছি! আর্ট পেপারকে কার্ডের মতো কেটে তার উপর পাতা বা ফুল বসিয়ে পুরোনো ব্রাশ আলতার মধ্যে চুবিয়ে বুড়ো আঙুলের ছিটেয় ভরে উঠত সাদা কার্ডটা। রং ছেটানো হয়ে গেলে পাতা বা ফুল তুলে নিলেই বেশ সুন্দর ছাপ পড়ে যেত ওতে। দেখতেও অপূর্ব লাগত।
সন্ধেবেলা বাবা-মায়ের হাত ধরে বাজারে চলে যেতাম। ওঁদের বাঁধা দোকানগুলোয় শুরু হত হালখাতা। সারা বছরের বাকি টাকার কিছুটা মেটানোর পর মিলত একটা রোল করা ক্যালেন্ডার, এক প্যাকেট মিষ্টি। কত তো মিষ্টি চেখেছি এতদিন ধরে, কিন্তু ওই থেঁতলে যাওয়া চমচম আর ঠান্ডা জল হয়ে যাওয়া শিঙাড়া বা কচুরির স্বাদ আজও মুখে লেগে আছে। রোল করা ক্যালেন্ডারটা ছিল অসম্ভব কৌতৃহলের। ওই সাদার পিছনে কোন ঠাকুর দেবতার ছবি, পাহাড়, সমুদ্রের ছবি লুকিয়ে আছে, তা যতক্ষণ না পর্যন্ত আবিষ্কার করতাম, অস্থির-অস্থির লাগত। কোনও কোনও বছর পাড়ার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার ডাক আসত, নতুন বছরের আগমন শুরু হয়ে যেত- ‘এসো হে বৈশাখ’ গানে গানে।
এসব এখন স্বপ্ন-স্বপ্ন লাগে। পয়লা বৈশাখের সেই সুন্দর সকালটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল! রাত বারোটার অনেক আগে থেকেই মোবাইলের মেসেজ বক্সে টুংটাং ঢুকতে থাকে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’-এর ডিজিটাল বার্তা। সকাল থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার পাতা ভরে যায় ‘ডাউনলোডেড’ নানা কারিগরি করা ছবিতে। শুভ নববর্ষ আর হ্যাপি নিউ ইয়ারের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে না পারা মানুষজন স্বরচিত কবিতায় নিজেদের জাহির করতে ব্যস্ত থাকে সারাদিন। কোলাকুলি, একে অন্যের বাড়ি মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে শুভেচ্ছা জানানো এখন অতীত। স্মার্ট ফোন এখন অতি সহজলভ্য, আঙুলের কয়েকটা খোঁচায় বার্তা পৌঁছে যায় দূর থেকে দূরতম দেশে। অথচ ভাবতে অবাক লাগে সেই বার্তা মনের কাছে পৌঁছয় না। পাড়ায় পাড়ায় কত অনুষ্ঠানের আয়োজন এখন, চলছে অনলাইন প্রতিযোগিতা। বৈশাখের গানে-কথায় জমজমাট চারিদিক। অথচ কত প্রাণহীন এই উদযাপন! কোথায় হারিয়ে গেল সেই পাড়ার চাঁদা তুলে বানানো ছোট্ট প্যান্ডেলের নিচে বসা জলসা, কোথায় হারাল সেই কার্ড দেওয়াদেওয়ির নির্ভেজাল সম্পর্কের দিন।
এখন সব কিছুই যেন ব্যবসাকেন্দ্রিক। বৈশাখ আসার ঠিক আগ মুহূর্তের চৈত্র সেলেও সেই দৃশ্য চোখে পড়ে। যেন ‘সেল’ দিচ্ছে বলেই কিনতে এসেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ! পয়লা বৈশাখের সেই আবেগ চোখে পড়ে না আর। রকমারি পোশাকের ভিড়ে হারিয়ে গেল সেই ফুলছাপ সুতির জামা পরা মেয়েটা। ওকেও আজকাল আর কোথাও খুঁজে পাই না। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা যে ভদ্রলোকটি পালিশ করা ধবধবে পোশাকে হালখাতা করতে যেতেন তিনি এখন ঘরবন্দি। নানা রোগ কাহিল করেছে তাঁকে। তবু ভুলে যাওয়া অসংখ্য স্মৃতির মধ্যে আবছা সেই পয়লা বৈশাখের কথা আজও হয়তো তাঁর মনে উঁকিঝুঁকি দেয়। বছরের প্রথম দিন তাই হয়তো তিনি বালিশের নিচ থেকে কুঁকড়ে যাওয়া টাকা বের করে বলেন, ‘সকলের জন্য মিষ্টি নিয়ে আয়!’ কিংবা খোঁজ নেন কোন দোকানে কোন ক্যালেন্ডার দিল!
বৈশাখ মাসের প্রথম দিনের দুপুরে সবাই মিলে পোলাও, মাংস খাওয়াতে যে স্বাদ, রেস্তরাঁর সাজানো বাহারি ‘মেনু লিস্ট’-এ তা যেন খানিকটা কমেই যায়। অবশ্য সেসব সাজানো থালার ছবি, ভিডিওতে সোশাল মিডিয়ায় লাইক, কমেন্ট, শেয়ারের বন্যা বয়ে যায়, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’-র আবেগ আজ সত্যিই পোশাকি, এতে না আছে মনকে ছুঁয়ে যাওয়া আয়োজন, না আছে হৃদয় নিংড়ানো ভাবাবেগ।
পয়লা বৈশাখের মেকি আবেগ তাই দোসরা বৈশাখেই শেষ হয়ে যায়, ইংরাজি সাল লিখতে গিয়ে কখনও হোঁচট না খেলেও বাংলা সন, তারিখ লেখার আগে দ্বিধান্বিত হয়ে একবার জিজ্ঞেস করে উঠি, এটা চোদ্দ’শ কত যেন? আরে ঠিকই তো, এবার থেকে চোদ্দ’শ পড়বে, কত পড়ছে তা সত্যি সত্যিই মনে পড়ছে না তো! তবু পয়লা বৈশাখে প্রতি বছরের মতোই কেজো গলায় সকলকে বলে উঠি, শুভ নববর্ষের প্রীতি ও শুভেচ্ছা। কিছু কিছু জিনিস জীবনের সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকে, এও ঠিক যেন তেমনই। তাই তো আরও অন্য সবকিছুর মতো ‘পয়লা বৈশাখ’ আজও বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।