বাঙালির পয়লা বৈশাখ। পয়লা বৈশাখের বাঙালি। ঠিক আগের মতোই আছে! নাকি পয়লা বৈশাখ নেহাত পোশাকি উদযাপনে এসে ঠেকেছে? তা নিয়েই নিজের ভাবনা জানালেন, মধুমিতা রায়।
পড়ে শোনালেন: চৈতালী বক্সী। গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক।
ছোটবেলায় আমার পয়লা বোশেখের সকাল শুরু হত মন্দিরে পুজো দিয়ে। মামার বাড়ি বৈদ্যবাটিতে। যা ওখানে কালীবাড়ি, বীরভূমে তা কালীতলা। আমার বাড়ি বোলপুরে। শান্তিনিকেতন থাকায় জায়গাটার একটা ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু’ রবীন্দ্র-পরবর্তী আমলেও থেকে গিয়েছে। অথচ বলে রাখি, শান্তিনিকেতন আদপে কোনও জায়গা নয়। একটি বাড়ির নামেই গোটা জায়গার পরিচিতি। জায়গাটা কিন্তু বোলপুর। এহেন মফস্সলে কলকাতার মানুষের ঢল নামে। পয়লা বোশেখের আশেপাশে তাপমাত্রার পারদ চড়লেও ভিড়ের কমতি নেই। ইদানীং প্যাকেজ সিস্টেমে সকলে অভ্যস্ত। দু’তরফের জন্যই বেশ লাভজনক। একসঙ্গে কঙ্কালিতলা, চাইলে তারাপীঠ, কবিগুরুর আশ্রম, সোনাঝুরির হাট আর বাউল গান। সবেতেই বাঙালিয়ানা ভরপুর।
বছরভর বাংলা মিডিয়াম শুনে নাক কোঁচকানো বাঙালির দল, পয়লা বৈশাখে একদিনের জন্য অতি কষ্টে শাড়ি আর পাঞ্জাবিতে মন দেন। আজকাল তো আবার রেডিমেড শাড়ি-ধুতিও দিব্যি পাওয়া যায়। সারাটা দিন ঘোরাঘুরি করে দুপুর গড়ায়। অন্যদিন বাড়ির শুক্তো, মাছের ঝোল মুখে না রুচলেও এদিন কিন্তু বাঙালি খাবার মাস্ট। শহরের ফাইন-ডাইনিং থেকে মফস্সলের রেস্তরাঁ সবেতেই ইস্পেশাল সব খাবার। আলু ভর্তাও বিকোয় হাজারে। বাড়ির মড্যুলার কিচেনের গেট-আপ অনুযায়ী শিল-নোড়া আজ আর চলে না। কুছ পরোয়া নেহি! বুফেতে জায়গা করে নিয়েছে শিলে বাটা মুরগি, পোস্তবাটা আরও কত কী! ওগুলো খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই না হয় রান্না নিয়ে এক্সপার্ট কমেন্টগুলো করে নেওয়া যাবে। বাঙালির নববর্ষ কি আদৌ বাঙালির? নাকি দুর্গাপুজোর মতোই তা ঔপনিবেশিক আধুনিকতারই এক প্রকৃষ্ট নিদর্শন।
পণ্ডিতি তর্ক আপাতত তোলা থাক শিকেয়। বরং একটু বিকেলবেলায় ফেরা যাক। সুসজ্জিত দোকানগুলোতে সদর মফস্সল সবখানেই প্রায় হালখাতা টিকে আছে। সেইসঙ্গে কার্ড দিয়ে নেমন্তন্ন আর মুখ দেখালেই মিষ্টির প্যাকেট এবং ক্যালেন্ডার। মিষ্টির প্যাকেটের গজা খাবেন না বিলি করবেন সে আপনার ব্যাপার, কিন্তু ক্যালেন্ডারটা রেখে দেওয়াই যায়। যদিও পরে তারিখ তো দূর অস্ত, বাংলা সাল মনে রাখাই দায় হয়ে পড়ে। আর যা বিকোয় তা হল পঞ্জিকা। বিয়ে, পৈতে, গৃহপ্রবেশের দিনক্ষণ দেখা হয়ে গেলেই বস্তুটার জায়গা হয় ঘরের এক কোণে।
তবে মোটের ওপর আমি মানুষটা আশাবাদী। এবারেও দেখেছি বেশ কিছু অল্পবয়সী ছেলেমেয়েকে, বাংলা বইয়ের স্টলে ভিড় করতে। আমার বেশ লাগে পিটার প্যান আর অ্যালিসের পাশাপাশি ‘হলদে পাখির পালক’-এ ডুবে যেতে; জন কীটস্ আর জীবনানন্দের বিষাদের ভাষা একসঙ্গে বুঝতে। মেল্টিং পটের যুগে বিরিয়ানি একেবারে বাদ পড়ুক তা চাই না, তবে বাড়ির বিউলির ডাল আর আলুপোস্তকে অবহেলা করে নয়। দোকানগুলোতে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা হোর্ডিং থাকুক আর মন ভালো করতে একটু আধটু রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ। সেইসঙ্গে এ-ও যেন মনে রাখি যে, কলকাতার কৃষ্ণনাগরিক বাংলা আর রসগোল্লাই কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতির একমাত্র ধারক-বাহক নয়। রসগোল্লার পাশাপাশি বাঙালি রসনায় জায়গা করে নিক কীর্ণাহারের মন্ডা বা বহরমপুরের ছানাবড়া। আমাদের মননে বাংলা সংস্কৃতির বহুস্বর থেকে যাক। পয়লা বোশেখের দিনশেষের রাঙা আলো ম্লান হয়ে যায় ধীরে ধীরে। নতুন দিনে নতুন করে নিজেদের বোঝা শুরু হোক তবে!