‘ভূগোল পালটায়, ইতিহাসও, কিন্তু স্মৃতির ভিতর আঁকা মানচিত্র পালটাবে কে যে! সেই মানচিত্রই বারবার এঁকে যায় কবিতা, গান। … প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়েছে যে অনুভূতি। কখনও সরাসরি, কখনও ইঙ্গিতে। সামগ্রিকতার মধ্যেও সেই বেদনার খোঁজ। সময় পালটায়, অনুভূতি ফিকে হয়, হারায় না কোনোদিন…’।
দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনের প্রাক্কালে ফিরে ফিরে আসে দেশভাগের স্মৃতিও। সে-বড় সুখের স্মৃতি নয়। তবু জাতির সেই ভাগ্য-বিপর্যয় স্মরণ করতে হয় আমাদের। কেননা সমসময়ের সংকটকে মোকাবিলা করতে হলে, এই ইতিহাসকে স্বীকার করে নিয়েই, সন্ধান করতে হবে নতুন কোনও পথের। সম্প্রতি সেই অনিবার্যতা থেকেই দেশভাগ স্মরণে হল এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান, ২৩ জুলাই, মহাবোধি সোসাইটিতে।
আরও শুনুন: দেবেশ রায়ের বিস্তার: বাংলা ভাষার মহালেখককে অনুভবের প্রয়াস
এই অনুষ্ঠানের কেন্দ্রে থাকল একটি বই। তরুণ কবি তন্ময় ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় সংকলিত হয়েছে দেশভাগ এবং এর অনুষঙ্গে রচিত বাঙালি কবিদের কবিতা ও গান। ‘দেশভাগ এবং’ নামের বইটিতে প্রায় ৩০০ জন কবির অনুভব ধরা রয়েছে দু-মলাটে। এই বইপ্রকাশকে কেন্দ্র করেই দেশভাগ সম্পর্কিত আলোচনায় অংশ নিলেন পবিত্র সরকার, অমর মিত্র, সব্যসাচী দেব এবং বিশ্বজিৎ রায়। পবিত্রবাবুর জীবনেই নেমে এসেছিল দেশভাগের বিপর্যয়। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ঘটিয়ে তোলা একটি ঘটনা যে কীভাবে একটা পরিবারকে বিচ্ছিন্ন, ছিন্নমূল করে তুলেছিল, ব্যক্তিজীবনে কতখানি বিপর্যয় ডেকে এনেছিল, তাই-ই শোনাচ্ছিলেন তিনি। আসলে এই স্মৃতিই আমাদের মনে করিয়ে দেয়, যে মূল্যে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, কত মানুষ যে জীবন দিয়ে তার মূল্য চুকিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এই স্মৃতি আসলে একটি ‘ক্ষত’। যে-ক্ষতের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন সব্যসাচী দেব। উল্লিখিত বইটির ভূমিকাটিতেও তিনি বলেছিলেন, ‘ভূগোল পালটায়, ইতিহাসও, কিন্তু স্মৃতির ভিতর আঁকা মানচিত্র পালটাবে কে যে! সেই মানচিত্রই বারবার এঁকে যায় কবিতা, গান। … প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়েছে যে অনুভূতি। কখনও সরাসরি, কখনও ইঙ্গিতে। সামগ্রিকতার মধ্যেও সেই বেদনার খোঁজ। সময় পালটায়, অনুভূতি ফিকে হয়, হারায় না কোনোদিন…’। সত্যিই যে তা হারায় না, উত্তরকালের এই অনুসন্ধান তারই সাক্ষ্য বহন করছে।
স্মৃতির সঙ্গেই লগ্ন হয়ে থাকে সমসময়ের সংকটও। অমর মিত্রের কথায় উঠে এল সেই প্রসঙ্গ। আজকের ভারতবর্ষেও তো একই রকম ছিন্নমূল হয়ে বা হওয়ার ভয়ে দিন কাটাচ্ছে মানুষ। আর তাই দেশভাগ-কে গুরুত্ব সহকারে দেখা যে আমাদের একান্ত কর্তব্য, তা বারেবারে মনে করিয়ে দিলেন তিনি। আবেদন জানালেন, এই ইতিহাস, ক্ষত ও রক্তের এই বয়ানকে আরও বড় পরিসরে তুলে ধরার, যাতে এই ইতিহাস-ই উত্তরপ্রজন্মের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠতে পারে। বিশ্বজিৎ রায় তাঁর বক্তব্যে আরও প্রাঞ্জল ভাবে ধরিয়ে দিলেন সেই সূত্রটি। দেশভাগের সঙ্গে আজকের প্রজন্মের দূরত্ব যেমন অনেকখানি, তেমনই এমন কেউ থাকতেই পারেন, যাঁর দেশভাগজনিত কোনও স্মৃতিই নেই। ফলত স্মৃতির যে আবেগ তা হয়তো কার্যকর নয় ব্যক্তিবিশেষে, কিন্তু দেশভাগকে এখান দেখতে হবে ঐতিহাসিকতার নিরিখেই। বিশেষত যে সময়টায় এক জাতি, এক আবেগ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্তরে, অস্বীকার করা হচ্ছে বহুত্বকে- সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এই দেখা বা সন্ধান আরও জরুরি। জাতীয়তাবাদের ভ্রান্ত ধারণা যদি জাতিকে পেয়ে বসে, তবে বিপর্যয়ের আর-এক মাত্রা স্পর্শ করা হয়। আর তাই বিশ্বজিৎবাবুর প্রস্তাব, যত নিষ্ঠুর সত্যিই হোক না কেন, দেশভাগের ইতিহাস আমাদের পড়তে হবে। পড়তে হবে বিপর্যয়ের বিবরণ। তা যে প্রতিহিংসায় আমাদের প্ররোচিত করবে তা নয়, বরং এই পাঠ আগত বিপর্যয়ের মুখে আমাদের একরকম রক্ষাকবচ হয়ে থাকবে।
স্মৃতি ও সংকটকে মুখোমুখি বসিয়ে এভাবেই নতুন পথ সন্ধানের দিশা দেখাল এই আলোচনা-সভা। এরকম একটি বই প্রকাশ ও তাকে কেন্দ্র করে এমন মনোজ্ঞ আলোচনা আয়োজনের জন্য অবশ্যই ধন্যবাদার্হ হয়ে থাকল প্রকাশনা সংস্থা ‘সৃষ্টিসুখ’।