বন্ধুবর শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লেখা চিঠিতে নিজের জন্মদিন নিয়ে দু-কলম লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই বোধহয় প্রথমবার। তবে প্রথমবার কবিগুরুর জন্মদিন পালনের আয়োজন সারেন তাঁর ভাগ্নি, অর্থাৎ কবির ন’দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবী। কবির জন্মদিনের মুখর তিথির বিবরণ দিলেন শুভদীপ রায়।
পঁচিশে বৈশাখ। পাঁজিতে এই দিনের কোনও শাস্ত্রীয় গুরুত্ব নেই। কিন্তু এ দিনের সাংস্কৃতিক গুরুত্বকে স্বীকার না করে উপায় কী! পঁচিশে বৈশাখ মানেই পাড়ায় পাড়ায় উৎসবের আমেজ, মাইকে অ্যান্থেমের মতো ‘হে নূতন’-সহ রবীন্দ্রসংগীত, সব মিলিয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন যেন বাঙালির সাংস্কৃতিক কর্তব্য। কিন্তু এত উৎসবের আয়োজন যাঁর জন্য, সেই রবি ঠাকুর নিজের জন্মদিনে কী করতেন?
আরও শুনুন:
উদ্ধৃতিতে পড়া আর আটকে পড়া বাঙালির রবীন্দ্রনাথ
৮০ বছরের জীবদ্দশায় কবির জন্মদিন নিয়ে মাতামাতি কম হয়নি। আবার পালটা বিরোধও এসেছে। কবি নিজে কখনও চাননি কেউ তাঁকে ঈশ্বরের আসনে প্রতিষ্ঠা করুন। জন্মদিনের প্রতিভাষণে বারবার সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন কবি। আজ কবিপ্রয়াণের এত বছর পরেও সেই ভাবনা অবাক করে। সেই মুহূর্তে কবির সেইসব কথার অন্তর্নিহিত অর্থ নিয়ে কতটা চর্চা হয়েছিল বলা কঠিন। তবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কবিকে নতুন করে চেনায় তাঁর সেইসব প্রতিভাষণ।
ফেরা যাক জন্মদিনের প্রসঙ্গে। ছেলেবেলার নানা ঘটনার প্রসঙ্গ কবিগুরুর লেখায় খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে জন্মদিনের উল্লেখ নেই বললেই চলে। প্রথমবার ঘটা করে মেয়ে ইন্দিরার জন্মদিন পালন করলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। ভাইঝির জন্মদিনে কবিতা উপহার দিলেন রবীন্দ্রনাথ। এরপরই হয়তো কবির মনে জন্মদিন নিয়ে বিশেষ উৎসাহ জন্মায়। সেই আঁচ মেলে বন্ধুবর শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লেখা কবির চিঠিতে। নিজের জন্মদিন নিয়ে চিঠিতে দু-কলম লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই বোধহয় প্রথমবার। ১৮৮৬ সালের ৭ মে অর্থাৎ ২৫শে বৈশাখে লেখা ওই চিঠিতে। তবে প্রথমবার কবিগুরুর জন্মদিন পালনের আয়োজন সারেন তাঁর ভাগ্নি, অর্থাৎ কবির ন’দিদি স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবী। পঁচিশে বৈশাখের সকালে বকুল ফুলের মালা, সঙ্গে ধুতি, চাদর, ইংরেজি কবিতার বই নিয়ে ‘রইমা’র বাড়ি হাজির হন। ওই নামেই কবিকে ডাকতেন সরলা দেবী।
আরও শুনুন:
ডাকলে বাঙালি যে ঠাকুরের দেখা পায়, তিনিই রবীন্দ্রনাথ
এরপর থেকেই কবিগুরুর জন্মদিন পালন একপ্রকার নিয়মে পরিণত হয়। দীর্ঘদিন ঘরোয়াভাবেই কবিগুরুর জন্মদিন পালন করা হত। জন্মদিনে নিজের হাতে ইংরেজি কবিতার অনুবাদ করে প্রিয় কাকাকে দিয়েছিলেন ইন্দিরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবির জীবনেও শূন্যতার আকাশ বড় হতে থাকল। ১৯০২ সালে চলে গেলেন স্ত্রী মৃণালিনী দেবী। প্রায় কাছাকাছি সময় একে একে চলে গেলেন আরও অনেক কাছের মানুষ। এদিকে কবি হিসেবে দেশ বিদেশে আরও খ্যাতনামা হয়ে উঠছেন রবীন্দ্রনাথ। একের পর এক লেখা। সেই নিয়ে ব্যাপক সুখ্যাতি। জানা যায়, কবির ৪২ বছরের জন্মদিন পালন করা হয়েছিল শান্তিনিকেতনে। তবে যে জন্মদিন নিয়ে এখনও বিভিন্ন মহলে চর্চা চলে, তা কবির পঞ্চাশ বছরের আবির্ভাব তিথি। সেবার শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকরা কবির জন্মদিনের আয়োজন সারেন। সেই বোধহয় প্রথমবার বাড়ির বাইরে ঘটা করে কবিগুরুর জন্মদিনের আয়োজন। তেমন কোনও আড়ম্বর ছিল না। স্রেফ আন্তরিকতার ভারেই এই অনুষ্ঠান কবিকে আপ্লুত করেছিল। দিনটা শান্তিনিকেতনের ছাত্র-অধ্যাপকরা আত্মীয়তার উৎসব হিসেবেই পালন করেছিলেন। সেবার আম্রকুঞ্জে অনুষ্ঠানের আয়োজন হয় ভোরবেলা। সাজানো হয়েছিল ফুল, আলপনায়। একেবারে ভারতীয় ধাঁচে জন্মদিন উদযাপন। সেখানে গানে গানে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনই মূল কথা। প্রথমে মঙ্গলগীত, তারপর একে একে বিদ্বজ্জনের ভাষণ। রবীন্দ্রনাথ তখন গুরুদেব। কিন্তু তাঁকে কেউ যেন ঈশ্বরের আসনে না বসায়, সেই অনুরোধই করে যেতেন ক্ষিতিমোহন সেন, পণ্ডিত বিধুশেখর ভট্টাচার্য্য কিংবা নেপালচন্দ্র রায়ের মতো গুণীজনেরা। অনুষ্ঠান শেষে কবিকে অসংখ্য ফুলের মালা পরিয়েছিলেন ছাত্ররা। সেইসঙ্গে প্রণাম করার ধুম ছিল দেখার মতো। সুনীল দাস তাঁর বইয়ে লিখছেন, প্রায় আধঘণ্টারও বেশি সময় দাঁড়িয়ে থেকে রবীন্দ্রনাথ প্রায় শ-তিনেক মানুষের প্রণাম গ্রহণ করলেন। তবে এই সবকিছুর মধ্যে কবিগুরুর প্রতিভাষণটি বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। সমীর দাসের বইয়েই সে অংশের সন্ধান মেলে। কবি বলছেন, “আমাকে আপনারা যে উপহার দিলেন, সেগুলি পাবার আমি কতখানি যোগ্য তা যদি আমি মনে করতে যাই, তাহলে আমাকে লজ্জিত হতে হবে। কিন্তু একটা ক্ষেত্র আছে, যেখানে মানুষের কোনও লজ্জা নেই, সেটা প্রীতির ক্ষেত্র। এইসব উপহার আপনারা আমাকে প্রীতির সহিত দিচ্ছেন, সেইজন্য এসব গ্রহণ করতে আমার কোনও বাধা নেই।” একইভাবে কবিগুরুর পঞ্চাশ বছর পূর্তির জন্মদিনেও আয়োজন করেছিলেন শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকরা। এবং বছরের পর বছর একইভাবে কবিগুরুর জন্মদিন পালিত হয়েছে। সবসময় কবি থাকতে পারেননি। এমনকি দেশের বাইরেও জন্মদিন কাটাতে হয়েছে কবিকে। তবে সমস্ত জন্মদিনেই প্রতিভাষণ পাঠিয়েছেন। যা প্রমাণ করেছে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জীবনে জন্মদিন পালনের ভূমিকা কতটা বদলেছে।
এ প্রসঙ্গে আরও এক জন্মদিন পালনের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। অবশ্য কবিগুরুর জন্মদিন। তবে বাড়ির কেউ বা শান্তিনিকেতনের আত্মীয়রা নন, কবির জন্মদিনের আয়োজন সেরেছিলেন রবীন্দ্রানুরাগীর দল। সে দলের একেবারে সামনের সারিতে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তর মতো মানুষ ছিলেন। এছাড়াও ছিলেন চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী প্রমুখ। একেবারে চাঁদা তুলে কবিকে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। গড়া হয় বিশেষ সমিতিও। অনুষ্ঠানের আসর বসেছিল কলকাতার টাউন হলে। উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন বঙ্গ সাহিত্য সমাজের ইন্দ্র-মিত্র-বরুণরা। মধ্যমণি হয়েছিলেন কবিগুরু। একাধিক উপহারে ভরিয়ে দেওয়া হয় কবিকে। যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য একটি সোনার পদ্মফুল। কাশ্মীরের শিল্পীর তৈরি এই ফুল নিজের ইচ্ছামতো খোলা বা বন্ধ করা যেত। অনুষ্ঠানে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মতো মানুষও ছিলেন। পরবর্তীকালে রবি-জন্মদিন পালনে যাঁর বিশেষ ভূমিকা লক্ষ করা যায়। টাউন হলের রবি-সংবর্ধনার পরদিন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের তরফেও এক সান্ধ্যসভার আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠান নিয়ে সমকালীন সংবাদপত্রে ব্যাপক লেখালেখি চলে। সর্বত্র রবীন্দ্রনাথের এই পঞ্চাশপূর্তির সংবর্ধনাকে অভাবনীয় সাফল্য বলে উল্লেখ করা হয়। খোদ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনাকে ‘রেড লেটার ডে ইন বেঙ্গলি লিটারেচার’ বলে অভিহিত করেন।
কিন্তু সব ভালো সবার ভালো লাগে না। এ ক্ষেত্রেও প্রতিবাদ এসেছিল। একদল কবিগুরুর এই জন্মদিন পালন খুব একটা ভালো ভাবে নেননি। তাঁরাই বিভিন্ন জায়গায় এর বিরুদ্ধে লিখতে শুরু করেন। বিষয়টা এতই গুরুতর পর্যায় পৌঁছয়, খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠিক করেছিলেন এই অনুষ্ঠানে থাকবেন না। এই নিয়ে আয়োজক সমিতিকে চিঠিও পাঠান তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত এমন কিছু হয়নি। রামেন্দ্রসুন্দরের অনুরোধে কবি অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ভাগ্যিস, এমনটা হয়েছিল। কারণ এরপরই কবি নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন। কাজেই বিশ্বের দরবারে স্বীকৃত হওয়ার পরই কবিকে দেশের তরফে সম্মান জানানো হল, এ চরম লজ্জার। এরপর কবির ৬০ বছরের জন্মদিনেও কম ঘটা হয়নি। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের তরফেই বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে হয়েছিল। পরবর্তী জন্মদিনে ঘটা আরও বাড়ে। তবে কবির ৭০তম জন্মদিনটিকে স্মরণীয় বলতেই হয়। কলকাতায় সেবার আয়োজন করা হয়েছিল রবীন্দ্র জয়ন্তীর। তার জন্য বিশেষ এক সভারও আয়োজন করা হয়। যার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন অমল সেন। সেখানে প্রস্তাব রেখেছিলেন সি ভি রমণের মতো ব্যক্তিত্ব। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠান স্রেফ সভার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এই উপলক্ষে প্রদর্শনী মেলারও আয়োজন করা হত। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজন করা হত অনুষ্ঠান। সেখানে গান, নাচ, নাটক সবই চলত। সেই ধারা এখনও বদলায়নি। কবিগুরুর জন্মজয়ন্তী পালন এখন উৎসবের থেকে কম নয়। হোক না গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো, তাতেই এ ঠাকুর সন্তুষ্ট।