কালিদাস যখন তাঁর কুমারসম্ভবের অষ্টম সর্গ লিখবেন কি না ঠিক করে উঠতে পারছিলেন না, তাঁকে নাকি পথ দেখিয়েছিলেন এক নগরনটী। কালিদাসের কাল থেকে বিশ্বায়ন-উত্তর পৃথিবী, তাঁরা রয়েছেন তাঁদের মতোই। সমাজবিচ্ছিন্ন নন, তবু যেন মূলস্রোতের সমাজ থেকে একটু দূরেই তাঁদের অবস্থান। এই দূরত্বটুকুই যেন আমাদের প্রবৃত্তিগত আদিমতা আর আধুনিকতার অন্তর্বর্তী হাইফেন। বারবনিতাদের বিবর্তনের ইতিহাস তাই আমাদের সভ্যতারও ইতিহাস, তবে যেন চাঁদের অপর পিঠ। সেই অনালোকিত ও অনালোচিত বাস্তবতাকেই দুই মলাটে তুলে আনতে চেয়েছেন দেবযানী ভট্টাচার্য, তাঁর ‘কলকাতার কসবি কিসসা‘ বইটিতে। সম্প্রতি প্রকাশিত বইটির পাতা উলটে সময়ের সেই অলিগলি ঘুরে দেখলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
নারীচরিত্রে গোঁফ দাড়ি কামানো পুরুষের অভিনয় দেখে দেখে চোখ পচে গিয়েছে। এবার চাই অভিনেত্রী। উনিশ শতকে পেশাদার থিয়েটার গড়ে ওঠার পর এমনই দাবি উঠেছিল। কিন্তু ভদ্র ঘরের মেয়েরা অভিনয়ে নামবে? দীপিকা-আলিয়া-ক্যাটরিনাদের স্বপ্ন দেখা আজকের দর্শক হয়তো কল্পনাও করতে পারবে না, সেকালে মেয়েদের অভিনয় করাকে কী চোখে দেখা হত। সেই সময়ে তাই অগতির গতি হয়ে এসেছিলেন ওঁরা। যাঁদের কেউ বলে পতিতা, কেউ বারাঙ্গনা, কেউ নাক সিঁটকে বলে বেশ্যা। যাঁদের থিয়েটারে নেওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন নারীমুক্তির অগ্রদূত খোদ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও। আবার তাঁদেরই একজনের অভিনয় দেখার পর শ্রীরামকৃষ্ণ আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, ‘তোমার চৈতন্য হোক’।
আরও শুনুন: দেশে প্রথম মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা, লড়াইয়ের অপর নাম সাবিত্রীবাই ফুলে
এমনই বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে ভরে ওঠে গণিকাদের জীবনের ঝুলি। এই মেয়েদের প্রতি লজ্জা-ঘৃণা-রাগ-সংবেদন-সহমর্মিতা যাই থাকুক না কেন, এদের অস্বীকার করার জো নেই কোনও সমাজেরই। সভ্যতার আদি যুগ থেকে ঘটমান বর্তমান পর্যন্ত তাই রয়ে গিয়েছে গণিকা ও গণিকাবৃত্তি। ‘কলিকাতার কসবি কিস্সা’ বইটিতে সেই পরম্পরাকেই খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন লেখিকা দেবযানী ভট্টাচার্য। প্রাচীন ভারতের নানান প্রদেশ থেকে নবীন বঙ্গের শ্রেষ্ঠ নগরে, বিভিন্ন যুগে ও যুগপতিদের কালে, কেমন ছিলেন তাঁরা? শরীরকে পণ্য করেই যাঁরা খুঁজে নিয়েছিলেন জীবিকা নির্বাহের উপায়?
আরও শুনুন: স্রষ্টার বিদায়, এবার ইতিহাস ছুঁয়ে অনন্তে উড়ান অক্ষরের ‘আগুনপাখি’র
উঁহু, ভুল হল। প্রাচীন কালের বারাঙ্গনারা কেবল দেহপসারিণী ছিলেন না আদৌ। রাজারাজড়াদের নির্ভরযোগ্য গুপ্তচরের কাজও করতেন সেরা গণিকারা। চৌষট্টি কলায় পারদর্শী হতেন তাঁরা। নৃত্য, গীত, বাদ্য, কাব্য রচনা, ভাষা শব্দ ও ছন্দের জ্ঞান, চিত্রাঙ্কন, প্রসাধন, মালা গাঁথা ও অলংকার বানানো, সূচিশিল্প, ব্যায়াম ও বিভিন্ন খেলায় পারদর্শিতা, কী ছিল না সেই চৌষট্টি কলার মধ্যে! এমন মেয়েকে দেখে কে না মুগ্ধ হয়! যেমন ঘটেছিল আম্রপালির ক্ষেত্রে। বৈশালীর অভিজাত পরিবারের পালিতা কন্যা আম্রপালিকে রানি হিসেবে পাওয়ার জন্য যখন একাধিক রাজা দাবি জানালেন, বৈশালীর গণ অর্থাৎ ক্যাবিনেট সেই মেয়েকে ঘোষণা করলেন জনপদবধূ রূপে। গণের ভোগ্যা অর্থেই ‘গণিকা’ শব্দের উৎপত্তি, জানাচ্ছে প্রাচীন জৈন গ্রন্থ ‘বাসুদেবহিনডি’।
শুনে নিন বাকি অংশ।
লেখিকা : দেবযানী ভট্টাচার্য
প্রকাশক : আখরকথা প্রকাশন