বোলপুর, শান্তিনিকেতনের উৎসব বলতে মুখে মুখে ফেরে পৌষমেলার কথা। কিন্তু সেটি ছাড়াও বোলপুরের অন্যতম আকর্ষণীয় একটি মেলা হল ‘নন্দনমেলা’। হেমন্তের মনখারাপমাখা বাতাস বোলপুরের ধুলোমাটিতে এসে লাগলেই পথঘাটে বেজে ওঠে নন্দনমেলার সুর। কী আছে এই মেলায়, সেখানে পৌঁছবেনই বা কেমন করে? আসুন, আজ শুনে নেওয়া যাক সেই নন্দনমেলার নানা তথ্য-তালাশ।
‘নন্দন’। একথা শুনলেই যেন চোখে ভেসে ওঠে হেমন্তের শিশির ভেজা মাটিতে এঁকে দেওয়া খড়িমাটির আলপনা। অথবা মা-ঠাকুমার কাঁথায়-কাঁথায় বোনা মিহি সুতোর কাজ। শুধু কি তাই? শুধুমাত্র একটু নান্দনিক রুচিতে কাদা-মাটির নানা ভাঙা-গড়া, এমনকী পরিপাটি করে সাজানো ঘরের কোণটুকুও শিল্পীর তুলির টানের মতো হয়ে উঠতে পারে নিখুঁত। আর সেই ভাবনাই নাকি অনেকখানি রশদ হয়ে উঠেছিল নন্দনমেলা প্রচলনের ইতিহাসে।
সাল ১৯৭৩। শান্তিনিকেতনের আশ্রমে তথা কলাভবনে সূচনা হয়েছিল শিল্পমেলার। সেসময় কলাভবনের অধ্যক্ষের দায়িত্ব ছিল দিনকর কৌশিকের কাঁধে। তিনি দিল্লি থেকে লখনউ আর্ট কলেজ হয়ে ফিরেছেন শান্তিনিকেতনে। সদ্য চলে গিয়েছেন নন্দলাল বসু। কলাভবনে তখন ভরপুর রয়ে গেছে নন্দলালের চলে যাওয়ার শোক। তবুও কৌশিকের হস্তক্ষেপে যেন কলাভবন ধীরে ধীরে ভুলতে শুরু করে নন্দলালের অনুপস্থিতির মনখারাপ। কারণ কৌশিকের নেতৃত্বে কলাভবনে অধ্যাপনার কাজে তখন একে একে যোগদান করছেন দিকপাল শিল্পীরা। সোমনাথ হোর, সনৎ কর, সুহাস রায়, ভাস্কর্য বিভাগে শর্বরী রায়চৌধুরী, অজিত চক্রবর্তী, জয়ন্ত চক্রবর্তী আরও অনেকে। আর ঠিক এমন সময় ঘটল একটি বিপত্তি!
ভাস্কর্যের কাজ করতে গিয়ে পায়ে বড় রকমের চোট পেল একটি ছাত্র। বিশ্বভারতীর হাসপাতালে তখন ছিল না আধুনিক চিকিৎসা-ব্যবস্থা। অথচ ছেলেটিকে অতি সত্বর কলকাতায় নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। বিশ্বভারতীর অর্থদপ্তরেও পাওয়া গেল না তেমন অর্থসাহায্য। অবশেষে, শিক্ষক এবং ছাত্রদের অনুদানে সেবারের মতো একটা উপায় বের করা গেল। কিন্তু কৌশিক দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারলেন না। ঠিক কয়েকদিনের মধ্যে কৌশিকের অধিনায়কত্বে কলাভবনে একটি শিল্প-মেলার আয়োজন করা হল। সেই মেলার পশরা হল ছাত্রদের হাতে তৈরি নানা শিল্পসামগ্রী। পরিকল্পনা হল, সেখান থেকে উঠে আসা টাকায় তৈরি হবে একটি ফান্ড। সকলেই একবাক্যে সায় জানাল সেই প্রস্তাবে। আর তখনই সূচনা হল এই মেলাটির। ধীরে ধীরে মেলা হয়ে উঠল চিরন্তন নন্দনভাবনার আঁতুড়ঘর।
তবে এখানেই শেষ নয়। মেলা শুরু হল। কিন্তু তা তো শিল্পী, আঁকিয়ে অথবা গুণীজনের মেলা। সমাজের সব মাপের মানুষ তাতে যোগদান করবে কেন? আর তাই মেলায় উঠে এল নতুন চমক। নন্দলাল-কন্যা যমুনার নেতৃত্বে মেলায় ঠাঁই পেল হাতে গড়া খাবার, চা, ভাজাভুজি আরও অনেক কিছু। ছাপানো ছবি, বাঁধনির কাপড়, খেলনা, ঘর সাজানোর নানান উপাদানে ধীরে ধীরে নন্দনমেলা হয়ে উঠলো এক মস্ত শিল্পসম্ভার। আজও এই মেলাটি একইরকম ভাবে বজায় রেখেছে তাঁর নিজস্ব ঐতিহ্য। পয়লা ডিসেম্বর থেকে এই মেলা শুরু হয়। আর ৩ ডিসেম্বর নন্দলাল বসুর জন্মদিনকে যেন আরও একটু রাঙিয়ে তোলে এই মেলার চিত্র প্রদর্শনী।
এবার প্রশ্ন, সেখানে উপস্থিত হবেন কেমন করে? বোলপুর স্টেশন থেকে সরাসরি মেলায় যাওয়ার জন্য পাওয়া যায় ই-রিকশা। তাতে চড়ে অথবা গাড়ি বুক করে আপনি পৌঁছোতে পারেন এই মেলায়। রাত্রিবাসের জন্য বোলপুরে রয়েছে অজস্র রকমারি রিসোর্ট। মেলা ছাড়াও বোলপুরে রয়েছে আরও অসংখ্য ঘোরার জায়গা। তাই এবারে শীতের ঘোরাঘুরির উইশলিস্টে নতুন করে অ্যাড করে নিতেই পারেন নন্দনমেলা।