সংখ্যায় অসংখ্য। দুয়ারে পুজো আর শিয়রে পুজোসংখ্যা। এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়! আবার কেউ কেউ বলছেন, আগের মতো ঠিক হচ্ছে না! তাহলে হচ্ছেটা কী? আর এই অগুনতি পুজোসংখ্যা পড়ার রেশে জিতবেনই বা কে? বাঙালির পুজো-পাঠের দিকে নজর দিলেন সম্বিত বসু।
নোটে গান্ধী, ঠোঁটে ভেসলিন, জোট-এ বিচ্ছেদ– সেরকমই ডাহা সত্যি কথা হল পুজো মানেই পুজোসংখ্যা। সে ভালো-মন্দ যা-ই হোক না কেন, কবিগুরু বলেছেন, ‘সত্যরে লও সহজে’। সবই তো ভালো ঘটছে, এমন নয়। ফি-বছর তেড়ে ডেঙ্গু হচ্ছে, বর্ষার কোনও সময়জ্ঞান থাকছে না, ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ পানসে লাগছে, উঠতি বন্ধুর মতো বিপথে নিয়ে চলে যাচ্ছে হতভাগা জিপিএস, তিস্তার জল উপচে পড়ছে, সাংবাদিককে রগড়ে দিচ্ছে রাষ্ট্র! তাহলে পুজোসংখ্যাই বা খামোকা আগাপাশতলা ভালো হতে যাবে কেন? কী-কী, কী বললেন? আগে হত? সে তো আগে ইতিহাসও পড়ানো হত। ফলে ওই হত এখন পুরোপুরি হত– অশ্বত্থামা হত, ইতি গজঃ।
আর কিছু বাঙালি বড় আদ্যিকেলে। সে পুরনো দিনের কথা ভেবে বালিশ ভিজিয়ে শ্যাওলা করে দেবে, তবু একাল নিয়ে হল্লা করবে না। এটা তো আর পুজোসংখ্যার সমালোচনা হতে পারে না যে, ‘আগের মতো নেই’। ‘কী নেই বলুন দিকিনি’ বলে এগিয়ে এলেই ঢোঁক গিলে বলবে ‘ওই যে, ওই সময়টা, ওই লেখা, ওই ছবি, ওই বিজ্ঞাপন, ওই গান।’ এ তো আচ্ছা জ্বালা! পুজোসংখ্যা কি টাইম মেশিন আর লেখক-শিল্পীরা সব অমর? পুজোসংখ্যার ওই মেজাজ বজায় রাখতে গেলে তবে তো, একজন লেখক নাম করতে-না-করতেই, তাঁকে ধরে-বেঁধে কাঁধে বন্দুক রেখে গোটা ৪০ ‘পুজোর উপন্যাস’ লিখিয়ে নিতে হবে। লেখক পরলোকে গেলেও, পুজোর পড়ালোকে যেন তাঁর নাম গোদা গোদা অক্ষরে ছাপা হয়। বাঙালির ‘পুজোসংখ্যা রক্ষা কমিটি’ কেন যে এত হা-হুতাশের পরও গড়ে উঠল না, কে জানে! পুজোয় জুতো-জামা-মণ্ডপ, মায় প্রতিমা নতুন করে আসছে, আর পুজোসংখ্যার বেলাই যত পুরনো!
এদিকে বাঙালি এমন বেয়াক্কেলে অভ্যেস বাগিয়ে ফেলেছে, পুজোসংখ্যা ছাড়া পুজো ব্যাপারটা কাটাতে গেলে তার বেজায় অ্যাসিড হয়ে যাবে। জেলুসিল-পুদিনহারা খেয়েও সেই বুক ছ্যাতরানো কমানো যাবে না। তার চে’ বরং দু’পাতা ওল্টাই। খানিকটা পড়ার পর, বিছানায় খানিক এতোলবেতোল করি। জানলা, প্রতিবেশী ছাদ পেরিয়ে সাঁ করে পৌঁছে যাই শরৎমেঘে। এক কাপ চা আহ্লাদ করে নিয়ে বসি। একটু হালকা ভলিউমে রবীন্দ্রসংগীত। আসলে ‘পুজোসংখ্যা’ ব্যাপারটা শুধু প্রতিষ্ঠানের বিশালবপু অক্ষরবিচিত্রা নয়। শুধু নামের ওজন আর আয়োজন নয়। শুধু গাদা গাদা লেখকের মিলনমেলার মাঠঘাট নয়। পুজোসংখ্যা ধরে রাখে এই শরৎকালের মেঘ, এই নিষ্পলক কাশফুল, রোদের হরেক ছায়াবাজি, সন্ধের সাময়িক ভিড়ও। ধরে রাখে এই গলির মণ্ডপ, কোচিং ফুরলেও বাড়ি না ফেরা কিশোর-কিশোরী চাউনি, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা মিতায়ু কমদামি রোল সেন্টার। পাড়াতুতো কুমোরটুলির মাটির প্রতিমা নির্মাণের মায়া ও বিস্ময়ও এসে পড়ে মাঝে মাঝে। মাটির সেই দুর্গাকে মাঝে মাঝে মিলিয়ে দেখা, এই পুজোসংখ্যার কোনও বিজ্ঞাপনে তাঁকে কি দেখা গেল সাজগোজের পর? পূর্ণ প্রতিমায়?
আগেই বলেছি পুজোয় শুধু নতুন পরব, তা নয়, নতুন পড়বও। দুটো মিলেই আমাদের ভেতর ও বাইরে নতুন করে তোলে। ছোট গুমটি হোক, বা রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা রোদভেজা হকার, তাঁদের কাছ থেকে পুজোসংখ্যা হাতেগরম নিয়ে উলটেপালটে বাছা অনেকটা প্রসাদের বিশাল পাত্র থেকে জাঁকালো ক’টা নিদাগ আঙুর বেছে নেওয়া। সরস্বতীর হাতের বইখানা পুজোর সময় পুজোসংখ্যা করে দিলেও বোধহয় শাস্ত্রজ্ঞরা তেমন রাগ করবেন না। তবে কোন পুজোসংখ্যা– সে নিয়ে বিস্তর তক্কবিতক্ক চলতে পারে। হতেই পারে বেণু মিত্তির লেনে একখানা, সাধন মজুমদার লেনে আরেকখানা, শিবপাড়ায় আরেকখানা– নানা পাড়ায় নানা পড়া। তবে এতে মাটির প্রতিমা খানিক বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবেন বইকি! কারণ সব জায়গাতেই যদি একই পুজোসংখ্যা হাতে থাকে, তাহলে প্রমাণিত হয়, সরস্বতীও তেমন বই-টই পড়ছেন না, নির্ঘাত মোবাইল ফোনে পেয়েছে তাঁকে। বুকওয়ার্মের দেবী নাকি ফেসবুকওয়ার্ম হবেন– কভি নেহি!
তবে, এ-ও ঠিক যে, হালে পিলপিল করে পুজোসংখ্যা বেরচ্ছে। কেউ শারদীয়া, কেউ শারদীয়, কেউ শুধুই শারদ, কেউ কাশফুল স্পেশাল– নানা ছদ্মবেশে আবির্ভূত হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যের তাতে যে খুব ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, এমনও না। মনে রাখবেন, বিসর্জনও পুজোর অঙ্গ।
এইবারে শেষ কথাটি। আপনারা একমত না-ও হতে পারেন। তবে আমার মতে, পুজোসংখ্যার এই অফুরন্ত বাড়বাড়ন্তের মধ্যে বই পড়ায় জিতে যেতে পারেন রাবণ বাবাজি। আমি শিওর, তিনি ছাড়া আর কোনও মক্কেলের পক্ষে সবক’টা পুজোসংখ্যা পূজাবকাশে হজম করার ক্ষমতা নেই! রাবণ হেলায় ও রেলায় পারবেন, কারণ দশ মাথার খানকুড়ি চোখ, এক সিটিংয়ে কুড়িখানা উপন্যাস পড়ে পগারপার। আর কী চাই! রাম অকালবোধন করে যেমন দুগ্গাপুজোয় ফেমাস, তেমন পুজোসংখ্যা পড়ে রাবণ ফেমাস হতেই পারেন। যদি এ লেখা পড়ে থাকেন রাবণ দাদাভাই, একবাট্টি ভেবে দেখবেন প্রস্তাবখানা, কেমন?