বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের রাজনৈতিক জীবন যেমন চর্চিত, তেমনই বিতর্কিত। বলা যায়, তিনি একই সঙ্গে নন্দিত ও নিন্দিত। তুমুল জনপ্রিয় আবার জনবিরোধী তকমাও তিনি পেয়েছেন। বাম আন্দোলনের লাল নিশান কি শুধু তাঁর জন্যই এ রাজ্যে মিলিয়ে গেল? নাকি বহুদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর তার সংস্কারের ইচ্ছে মিলেমিশে এমন এক দিকে গড়িয়ে গেল ইতিহাস, যার ব্যাখ্যা পাওয়া বেশ দুরূহ! প্রশ্নগুলো সহজ, তবে উত্তর নয়। সেখানে তাকে কী ভূমিকা নিতে হয় তা তার হাতে থাকে না। এ রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাস তাঁকে স্মরণ করবে একজন ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবেই।
লিখলেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়।
সেটা ২০০১ সাল। মে মাসের এক রবিবারে কলকাতায় আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএম রাজ্য দপ্তরে যেন একটা বিপ্লব ঘটে গেল৷ একদা শ্রেণিশত্রু বলে যাঁরা পরিচিত, সেই শিল্পপতিদের এক প্রতিনিধি দল বৈঠক করল সিপিএম রাজ্য দপ্তরে৷ এর কয়েকদিন আগেই অবশ্য বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধীন ফের বামফ্রন্ট সরকার গড়েছে ৷ আর তারও মাস ছয়েক আগে ২০০০ সালের ৬ নভেম্বরে পরিবর্তন ঘটেছে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী পদের৷ ১৯৭৭ সাল থেকে ২৩ বছরের বেশি সময় ধরে টানা মুখ্যমন্ত্রী থাকার পরে জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাটন তুলে দিয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে৷
গত শতাব্দীর শেষ পর্বে রাজ্যে যখন দু দশকের বেশি সময় ধরে সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বাম সরকার, তখন বিরোধী কংগ্রেস ভেঙে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গঠিত হল তৃণমূল কংগ্রেস৷ রাজ্যে মূল কংগ্রেসের নেতৃত্বকে সিপিএম-এর বি-টিম অ্যাখ্যা দিয়ে, মমতা বিরোধিতার ফোকাস টেনে নিতে চাইলেন নিজের দিকে৷ গ্রামে গ্রামে মানুষের সিপিএম তথা বামেদের বিরুদ্ধে ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে, আন্দোলন সংগঠিত করতে চাইলেন তিনি ৷
ঠিক এই সময়ে বাম জমানার দিকে একবার ফিরে তাকানো যাক। কৃষিতে ভূমিসংস্কার যা হওয়ায় হয়ে গিয়েছে। তাই এতদিন ধরে গড়ে তোলা গ্রামে গ্রামে বামেদের শক্তি কেমন যেন শিথিল হয়ে আসছিল ৷ কৃষি থেকে কর্মসংস্থান আর যথেষ্ট নয়। বিকল্প কর্মসংস্থান চাইছে মানুষ ৷ কোনও রকম রাজনৈতিক পালাবদলের আগে অনিল বিশ্বাস আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জুটি বাম সরকারের অন্দরে পরিবর্তন ঘটালেন মুখ্যমন্ত্রী বদলে দিয়ে ৷ তারপর বামফ্রন্টের নতুন স্লোগান ধ্বনিত হল- কৃষি আমাদের ভিত্তি শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ ৷
শিল্প-বাণিজ্য মহলকে খুব একটা পছন্দ করতেন না কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইপো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বরং তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন শিল্প-সংস্কৃতির মানুষজনদের সঙ্গে মেলামেশা করতে ৷ পরিস্থিতির চাপে তিনি নিজেকে কিছুটা বদলানোর চেষ্টা করতে লাগলেন৷ কারণ তিনিও অনুভব করেছেন মানুষের কাজের দরকার এবং তা শুধু কৃষিনির্ভর হলে চলবে না ৷ শিল্প চাই কর্মসংস্থানের জন্য৷ মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বুঝলেন, এবার আর শিল্পমহলকে ব্রাত্য করে রাখলে চলবে না, বরং তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে ৷ তাঁর পাখির চোখ হয়ে উঠল রাজ্যে শিল্পবিকাশ এবং কর্মসংস্থান৷
২০০১ সালে বিধানসভা ভোটের আগে আলোড়ন তুললেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষমেশ পশ্চিমবঙ্গ থেকে বামেদের উচ্ছেদ করতে পারলেন না৷ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার মাস ছয়েকের মধ্যে জনগণের কাছে পরীক্ষা দিয়ে জিতে ফের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য৷ আর তার কয়েকদিনের মধ্যে একটা বিপ্লব ঘটালেন পার্টির অন্দরে ৷ আলোচনার জন্য আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে পা রাখতে দিলেন বণিকসভা কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি- এর কর্তাব্যক্তিদের৷
এমন ঘটনায় শিল্পমহল তেমন কিছু বিস্ময় প্রকাশ করেনি৷ বরং তখন শিল্পমহলের অনেকেরই যুক্তি ছিল, দিল্লি মুম্বই হায়দরাবাদ বেঙ্গালুরু চেন্নাই অথবা নানা শহরে রাজনৈতিক দলের অফিসে গিয়ে তাঁরা বৈঠক করেছেন তাহলে পশ্চিমবঙ্গে এমন ঘটনায় অবাক হওয়ার কি আছে? কেউ বা প্রশ্ন তোলেন– সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে তাঁরা যদি ১০ নম্বর জনপথে গিয়ে দেখা করতে পারেন তাহলে আলিমুদ্দিনে বৈঠকে বাধা কোথায় ?
সেদিন অবশ্য প্রশ্ন ওঠাটা অস্বাভাবিক ছিল না। কারণ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের দলটার নাম যে সিপিএম। আর সেই দলের কাছে শিল্পমহল তো শ্রেণিশত্রু বলেই চিহ্নিত ছিল এতকাল ৷ রাইটার্সে তাও এদের সঙ্গে বৈঠক হতে পারে কিন্তু তাই বলে একেবারে পার্টির দপ্তরে যা অনেকেরই বাড়াবাড়ি মনে হয়৷ সেদিন দলীয় দপ্তরে এদের আসতে দেওয়াটা অবশ্যই একটা প্রথাভাঙা দুঃসাহসিক কাজ ৷ যেটা করার সাহস দেখালেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং দলের রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাস৷ তাঁরা চাইলেন, রাজ্য সরকারের সঙ্গে শিল্পমহলের দূরত্ব ঘুচুক – কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে একটা শিল্পবান্ধব পরিবেশ গড়ে উঠুক এ রাজ্যে ৷
যাতে এটা ইস্যু না হয় তাই সেদিন বলা হয়েছিল সেদিন রবিবার হওয়ায় রাইটার্স বিল্ডিং বন্ধ, তাই পার্টি অফিসেই বৈঠকের ব্যবস্থা করা হয়েছে ৷ তবু কথা উঠেছিল৷ কেউ কেউ কটাক্ষ করে বলেছিলেন– এই সরকারের এবার নতুন কোনও শ্রেণিশত্রু খোঁজা দরকার৷ যদিও লোকের সেই সব কথাকে পাত্তা না দিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কর্মসংস্থানের তাগিদে রাজ্য বিনিয়োগের জন্য শিল্পমহলকে আহ্বান জানিয়েছেন এবং মেনে নিচ্ছিলেন তাদের নানা শর্ত ৷ গোটা দেশের কাছে এই কমিউনিস্ট নেতা শিল্পবন্ধু বলে নিজেকে তুলে ধরেন৷ রাজ্যে লগ্নি করতে এগিয়ে আসে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী৷ কাজে গতি আনতে তাঁর ‘ডু ইট নাউ’ নীতির ফলে রাতারাতি হয়ে উঠলেন ‘ব্র্যান্ড বুদ্ধ’ ৷ কাজের জন্য কয়েক বছরের মধ্যে তিনি প্রশংশিত হন দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে৷
আবার একটা বিধানসভা নির্বাচন এসে যায়৷ ২০০৬ বিধানসভায় আরও ভাল ফল করে বামফ্রন্ট ৷ বিপুল জয় দেখে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মনে হয় তিনি যা করছেন ঠিকই করছেন এবং রাজ্যের মানুষ শিল্প চাইছে ৷ তখন সিঙ্গুরে ‘টাটা’র গাড়ি প্রকল্প, ইন্দোনেশিয়ার সালেম গোষ্ঠীর নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব এবং শালবনীতে জিন্দাল গোষ্ঠীর ইস্পাত প্রকল্প ছাড়াও বেশ কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীর নানা শিল্প প্রকল্প তখন এ রাজ্য আসছে৷ অন্তত এরকমটাই শোনা যাচ্ছিল। তবে শিল্পের জন্য চাই জমি৷ কিন্তু অনেক জায়গায় জমিদাতারা তা দিতে রাজি নন ৷ সেই সব মানুষের বিরোধিতা আর ক্ষোভের পাশাপাশি জন্ম নিচ্ছিল জমি বাঁচাও আন্দোলনের৷ কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয় বুদ্ধদেবের অন্তরে যে আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল তা তখন অহংকারে পরিণত হয়েছে৷ জমি আন্দোলনকারীদের অনুভূতি তিনি অনুভব করলেন না৷ এদের সকলকেই তাঁর রাজনৈতির বিরোধী মনে করলেন৷ যেন বিরোধীরা তাঁর শিল্পনীতির বিরোধিতা করছে ভেবে বলে উঠলেন – ‘‘আমরা ২৩৫ ওরা ৩০৷ বিরোধীদের কথা কেন শুনব?’’ জমি ও শিল্পনীতি নিয়ে দলের মধ্যে বা ফ্রন্টে বিরোধিতার মুখে পড়লে তিনি আমল দিলেন না৷ ২০০৬ বিধানসভা ভোটের কিছুদিন আগে অনিল বিশ্বাস মারা যান৷৷ ফলে নানা কাজে পার্টির বদলে আমলাদের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য৷ এদিকে সরকার জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে বাধা পাওয়ায় পুলিশের গুলি চলল৷ ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিতে ১৪ জনের মৃত্যু হয়৷ গুলিচালনার ঘটনায় রীতিমতো নিন্দার মুখে পড়লেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য৷ জনপ্রিয় এই নেতা রাতারাতি খলনায়ক বনে যান ৷ এদিকে অনিচ্ছুক কৃষকদের লাগাতার আন্দোলনের জেরে রতন টাটা ন্যানো গাড়ি প্রকল্প সিঙ্গুর থেকে সরিয়ে গুজরাতের সানন্দে নিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেন৷ ভোটারের মন তখন ক্রমশ শিল্প থেকে সরে জমি আন্দোলনের দিকে ঝুঁকেছে৷ ২০০৯ সালে লোকসভা ভোটে তার প্রতিফলন মিলল ৷ ২০০১ এবং ২০০৬ সালে বামেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে শেষরক্ষা করতে পারলেন না বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ৷ দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হল৷ এ রাজ্যে শিল্পবিরোধী তকমা মুছে শিল্পবান্ধব ভাবমূর্তি তুলে ধরে শিল্পে জোয়ার আনতে নিজেকে অনেকটা বদলে ফেলেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য৷ আবার সাফল্যের জন্য অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এবং অহংবোধই এই শিল্পবিপ্লবী কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রীর পতন ডেকে এনেছিল৷
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের রাজনৈতিক জীবন যেমন চর্চিত, তেমনই বিতর্কিত। বলা যায়, তিনি একই সঙ্গে নন্দিত ও নিন্দিত। তুমুল জনপ্রিয় আবার জনবিরোধী তকমাও তিনি পেয়েছেন। বাম আন্দোলনের লাল নিশান কি শুধু তাঁর জন্যই এ রাজ্যে মিলিয়ে গেল? নাকি বহুদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর তার সংস্কারের ইচ্ছে মিলেমিশে এমন এক দিকে গড়িয়ে গেল ইতিহাস, যার ব্যাখ্যা পাওয়া বেশ দুরূহ! প্রশ্নগুলো সহজ, তবে উত্তর নয়। মার্কসের কথা ধরেই বলা যায়, মানুষ নিজেই নিজের ইতিহাস তৈরি করে, তবে সেখানে তাকে কী ভূমিকা নিতে হয় তা তার হাতে থাকে না। বুদ্ধবাবুও এর ব্যতিক্রম নন। তবে এ রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাস তাঁকে স্মরণ করবে একজন ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবেই।