অসামান্য কণ্ঠই তাঁর যন্ত্র। তারসপ্তকে তিনি স্বচ্ছন্দ, আবার একই সঙ্গে তাঁর আছে একটি নিটোল খরজ। সত্যিকার সংগীতরসিকদের মধ্যে কোনও বিভাজন নেই, উস্তাদ রাশিদ খান যেন বিভাজন ভেঙে দিয়েছিলেন খুব অনায়াসে। তাই মার্গ সংগীতের শ্রোতা নন যাঁরা, তাঁরাও তাঁর একনিষ্ঠ শ্রোতা হয়ে উঠেছেন ক্রমে। তাঁর উদাত্ত কণ্ঠের জাদুতে মজে দৌড়েছেন ক্লাসিকাল গানের আসরে। লিখছেন সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়।
২০০২ সালের ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স। উস্তাদ আলি আকবর শেষবারের মতো বাজালেন। শ্রোতাদের চোখে জল। ঠিক তার পরই উঠলেন উস্তাদ রাশিদ খান। বয়স তখন তিনের কোঠায়। ধরলেন বিলাসখানি তোড়ি। আলি আকবরের শেষ বাজনার সুরের বেড়াজাল পেরিয়ে বিলাসখানি তোড়ির স্বর প্রক্ষেপণের মায়াজালে মুহূর্তে যেন বন্দি হয়ে গেলেন শ্রোতারা।
উস্তাদ রাশিদ খানের খেয়াল পরিবেশনের ভীষণ উল্লেখযোগ্য একটা দিক হল, বিস্তারের প্রথম এক-দু মিনিটের মধ্যে রাগের চিত্রটা ফুটিয়ে তুলতেন। অথচ বিস্তারের বিলম্বিত লয় বিঘ্নিত হত না বিন্দুমাত্র। দরবারি কানাড়া, বাগেশ্রী গাইবার সময় ‘কোমল নি’ এবং ‘কোমল গা’ স্বরে কিছুক্ষণ সুস্থির থেকেও, নিমেষে রাগের রূপ চিনিয়ে দিতে পারতেন রাশিদ।
কীভাবে চেনাতেন?
তাঁর অসামান্য কণ্ঠই তাঁর যন্ত্র। যার যাতায়াত সীমানা বিস্তৃত। তারসপ্তকে তিনি স্বচ্ছন্দ, আবার একইসঙ্গে তাঁর আছে একটি নিটোল খরজ। যা ভারতীয় মার্গসংগীত কেন, আমরা যদি ভারতীয় সংগীতজগৎ তথা মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির দিকেও নজর দিই, তাহলেও দেখব, এহেন কণ্ঠসম্পদ বিরল।
সাধারণত ভারতীয় ক্লাসিকাল ঘরানায় শিল্পীদের মধ্যে একধরনের উন্নাসিকতা আছে। আর সে উন্নাসিকতা থেকেই জন্ম নিয়েছে একটি বহুলপ্রচলিত শব্দ, ‘লাইট মিউজিক’। এই শ্রেণিবিভাজনের কোনও ব্যাকরণগত ব্যাখ্যা নেই। যারা সত্যি সংগীতরসিক, সংগীতপিপাসু, তাঁরা এ ধরনের অলীক শ্রেণিবিভাজনে বিশ্বাস রাখেননি কখনও। উস্তাদ রাশিদ খান কিন্তু সে বিভাজন ভেঙে দিয়েছেন খুব অনায়াসে। বিশুদ্ধ খেয়াল গানের চৌহদ্দির বাইরে এসে উদাত্ত গলায় গেয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রসংগীত কিংবা অন্যান্য নতুন গান, যা চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছে, পেয়েছে বিপুল জনপ্রিয়তাও।
তাই মার্গ সংগীতের শ্রোতা নন যাঁরা, তাঁরাও তাঁর একনিষ্ঠ শ্রোতা হয়ে উঠেছেন ক্রমে। তাঁর উদাত্ত কণ্ঠের জাদুতে মজে দৌড়েছেন ক্লাসিকাল গানের আসরে। বিলাসখানি তোড়ি কিংবা ইমন শুনে কেঁদে ভাসিয়েছেন।
আসলে মনে রাখতে হবে, সংগীত একটা আদ্যোপান্ত বিমূর্ত মাধ্যম। যে গানের কথা শ্রোতার বোধগম্য হচ্ছে, সে গানও একটি স্তরে গিয়ে বিমূর্ত হয়ে ধরা দিচ্ছে। আর সেই স্তর থেকেই সংগীতের প্রকৃত রসাস্বাদন শুরু। সেখানে তথাকথিত বোঝা বা না-বোঝার ঊর্ধ্বে একধরনের সেতু তৈরি হচ্ছে শ্রোতা আর সংগীতের মধ্যে।
উস্তাদ রাশিদ খান, তাঁর সমস্ত সংগীতসত্তায়, আজীবন সেই সেতু নির্মাণের কাজ করেছেন। তাই বোদ্ধা থেকে তথাকথিত সাধারণ শ্রোতা, সকলেই চোখের জল ফেলছেন শিল্পীর প্রয়াণসংবাদে।