তিনি ছিলেন কলকাতার নামজাদা সংগ্রাহক। অন্ধকার গলির মধ্যে একফালি ঘুপচি ঘর। সেখানেই থাকে তাঁর সন্তানসন্ততি। তাঁর সংগ্রহেরা। সেসব অজস্র ইতিহাসের সাক্ষী। সজীব তাঁর স্মৃতিও। সেইসব স্মৃতিচারণ ধরা পড়েছে দুই মলাটে। ‘আমি নকুবাবু‘ পড়ে জানালেন সুশোভন প্রামাণিক।
উত্তর কলকাতার গলি তস্য গলি পেরিয়ে একটা আদ্যিকালের তিনতলা বাড়ি। অবশ্য সহজ করে চিনিয়ে দেওয়া যায়। খান্না সিনেমার পিছনের গলি। শ্যাম মিত্র লেন। সেই রাস্তায় বাড়ির ঠিকানা, সাতের বি। এখানেই স্মৃতি আগলে ছিলেন সুশীলকুমার চট্টোপাধ্যায়। এটা তাঁর পোশাকি নাম। তাঁকে সকলে চিনতেন, নকুবাবু নামে। অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় পৌঁছালে ছোট্ট ঘরে, তাঁর বিরাট সংগ্রহশালা। সেখানেই গায়ে গা লাগিয়ে রয়েছে সতেরো আঠারো শতকের নানা জিনিস। কী নেই সেই তালিকায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের দম দেওয়া মুভি ক্যামেরা। ব্রিটিশ কোম্পানি থম্পসন-হাউস্টনের হেডফোন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত মেসেজ রিসিভার, যেখানে ধরা আছে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলিন, হিটলার, রুজভেল্টের কণ্ঠস্বর। ব্রিটিশ ইন্ডিগো প্লান্টারের তৈরি কলিং বেল, পকেট মাইক্রোস্কোপ, কম্পাস সহ স্প্যানিশ সূর্যঘড়ি, উইটনার মেট্রোনাম, শেলাকের তৈরি ৩ হাজার এলপি রেকর্ড প্লেয়ার, পোর্টেবল প্রজেক্টর, বিভিন্ন রকম ক্যামেরা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বাতি, সুইস স্টপওয়াচ, ব্রিটিশ কলিংবেল, রেলের গার্ডদের হ্যারিকেন… আরও কত কী!
আরও শুনুন: Kolkata : কলকাতা নাকি লটারির শহর! কেন জানেন?
এক দীর্ঘ সময়কে তিনি এই ছোট্ট ঘরে অত্যন্ত যত্নে এবং মমতায় আগলে রেখেছিলেন। নকুবাবু ওরফে সুশীলকুমার গত হয়েছেন বেশ কিছুদিন। তাঁর সংগ্রহ মিডিয়ার দৌলতে পৌঁছেছিল অনেকেরই সামনে। বিপুলা সেই ভাণ্ডার দেখে অনেকেই বিস্ময়ে হতবাক হয়েছেন। অনেকে দৌড়েছেন সেই সংগ্রহ চাক্ষুষ করতে।
অনেকেই তাঁকে উৎসাহ দিয়েছিলেন আত্মজীবনী লিখতে। অবশেষে শুভানুধ্যায়ী এবং প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদারের ক্রমাগত তাগাদায় লিখে ফেলেছিলেন আত্মজীবনীমূলক রচনা। তা থেকেই বই, ‘আমি নকুবাবু’।
নকুবাবুর জবানিতে দেখা মেলে একটুকরো পুরনো কলকাতার। ‘স্টার’ থিয়েটারে সেসময়ে মহিলা শিল্পীদের জন্য ছিল নিজস্ব ঘোড়াগাড়ি। সেই গাড়ির নাম ছিল ব্রুহাম। সেই গাড়ি টানত বিরাট বিরাট বিদেশি ঘোড়া। সেকালে কলকাতায় চলত দোতলা বাস। সেই বাসের চাকায় চেন লাগানো থাকত। ইঞ্জিনের নাম ছিল থরনিক্রক্ট। বড় বড় ট্যাক্সিতে গাদাগাদি করে ধরে যেত চোদ্দো-পনেরোজন। ডাক্তারদের জন্য স্পেশ্যাল রিকশা, করপোরেশনের লেডি ডাক্তারদের জন্য আলাদা রিকশা, আবার মিশনারি মহিলাদের রিকশা আরেকরকমের। সেসময় কলকাতার রাস্তায় গ্যাসের আলো জ্বালানোর জন্য ছিল নির্দিষ্ট লোক। কাঁধে লম্বা মই নিয়ে তারা ঘুরত। মই নিয়ে স্ট্যান্ডে উঠে ম্যান্টেল-এ আগুন ধরিয়ে তারা আলো জ্বালাত।
আরও শুনুন: গুন্ডাদের চোখে চোখ রেখে এগোলেন উত্তমকুমার, তারপর…
নকুবাবু হাওড়া ব্রিজ তৈরি হতে দেখেছেন। আবার সেই সময়ে পন্টুন ব্রিজ তৈরি হতেও দেখেছেন। বড় নৌকা বা জাহাজ এলে দুদিক থেকে ব্রিজের মাঝবরাবর অংশটা দুপাশে সরিয়ে নেওয়া হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, জাপানি বোমা পড়ার ভয়ে কাঁপছে কলকাতা। বোমার ভয়ে হাওড়া ব্রিজের ওপর ওড়ানো থাকত দুটো বড় বেলুন। তার নাম, ব্যারেজ বেলুন। দক্ষিণেশ্বরের দিকে যেত যে রেললাইন, তার পাশে ছিল একটি মজা খাল। তাকে বলা হত দেতের খাল। শুনেছিলেন ওই খাল দিয়েই নাকি দুর্ধর্ষ রঘু ডাকাত ডাকাতি করতে যেতেন।
বাকিটা শুনে নিন প্লে-বাটন ক্লিক করে।
আমি নকুবাবু
সুশীলকুমার চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশক – সপ্তর্ষি প্রকাশন
দাম – ৩৫০ টাকা।