প্রতিনিয়ত ভাঙনের পরম্পরা ছিল, কখনও-সখনও দেখা গিয়েছে চূড়ান্ত স্ববিরোধিতাও, কিন্তু পাশাপাশিই ছিল বিপদের মুহূর্তে পাশে দাঁড়ানোর মানবিক আবেদন। রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থার বিরুদ্ধে চিরকালই সোচ্চার বাংলা থিয়েটার।
ইতিহাস ধরে হেঁটে এলে থিয়েটারের সেই বলিষ্ঠ উচ্চারণই ধরা পড়ে। লিখছেন সোহম দাস।
রাজাজ্ঞা এসেছে, সোনার পাখি ফিরিয়ে আনতে হবে। আদেশ না-মানলে কী কঠোর দণ্ডাদেশ অপেক্ষা করছে তাই নিয়েও শঙ্কা। ইতিমধ্যে কিঞ্চিৎ ভাগাভাগির গল্প মঞ্চে উঠে পড়েছে। এক পক্ষ নির্দ্বিধায় প্রত্যাখ্যান করছে এই আদেশ, তাঁদের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই কম; এক পক্ষের মনে দ্বিধা, তাঁরা তাকিয়ে আছেন বৃহৎ সমষ্টি কী পদক্ষেপ নেয়, সেই দিকে। তবে, সবচেয়ে বেশি মুশকিলে পড়েছে বোধহয় তৃতীয় পক্ষ – একদিকে রাজানুগ্রহ হারানোর ভয়, অন্যদিকে বিবেক-দংশন, এ দুইয়ের সাঁড়াশি-চাপে তাঁরা বদলে নিতে চাইছেন ফরমানের ভাষা। সব মিলিয়ে, বিরোধিতার যা রকমসকম, তাতে পরিস্থিতি বেশ ঘোরালো।
অথচ, যাকে নিয়ে এত আলোচনা, এত ব্যঙ্গ, সেই বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসের দিকে যদি তাকানো যায়, তবে আজকের এই সিদ্ধান্তহীনতার কথা ভেবে লজ্জাই লাগে।
সেই উনিশ শতকের দীনবন্ধু মিত্র বা গিরিশ ঘোষদের আমলে না গেলেও চলবে। মাত্র আটটি দশক আগে ফিরে যাওয়া যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হব-হব করছে, ঐক্যবদ্ধ সাম্যবাদী শক্তির লড়াইয়ের সামনে ফ্যাসিবাদী শক্তির সমূহ পরাজয় অবশ্যম্ভাবী, এদিকে ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে সাম্রাজ্যবাদী নীতির বদান্যতায় বাংলাবাসী উপহার পেয়েছে ‘মহার্ঘ্য’ মন্বন্তর, ত্রিশ লক্ষ মানুষ এক নিমেষে হাওয়া হয়ে গেল। এমন এক দমবন্ধ পরিবেশে কলকাতার একদল যুবক-যুবতী কোন এক অসীম মন্ত্রশক্তির বলে হইহই করে বানিয়ে ফেললেন এক নাট্য প্রযোজনা। নাটক লেখা হয়েছে মাত্র নদিনে, মঞ্চসজ্জা বলতে কয়েকটা মাত্র চটের পর্দা, প্রগতি শিল্পী সংঘের সৌজন্যে অভিনেতা-অভিনেত্রীও জুটে গিয়েছিল অঢেল, তবে আনুষঙ্গিক বিষয়আশয় ছাড়িয়ে নাটকে মুখ্য হয়ে উঠল মানুষ – নিপীড়িত মানুষ, খেতে চাওয়া মানুষ, দুঃখের করাঘাত ভুলে উৎসবে মেতে ওঠা মানুষ। ১৯৪৪ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন ‘শ্রীরঙ্গম’ থিয়েটারে প্রথম অভিনীত হয়েছিল ‘নবান্ন’। মানুষের কথা বলতে চেয়েছিলেন কুশলীরা, তাই প্রয়োজনীয় পুলিশি অনুমতি পেতে অসুবিধা হয়েছিল। নাট্য-আঙ্গিক ও বিষয়ভাবনার ক্ষেত্রেও যে জলোচ্ছ্বাস এনেছিল ‘নবান্ন’, কিছুদিন পর থেকে তাকে গ্রহণ করা সম্ভব হল না পেশাদার রঙ্গমঞ্চের দিকপালদের পক্ষেও। শ্রীরঙ্গম থিয়েটারে প্রথম সাতরাত অভিনয়ের পর আর কখনও সেখানে অভিনয়ের অনুমতি দেননি শিশিরকুমার ভাদুড়ী, ‘রঙমহল’-এ সাতদিনের বুকিং দিয়েও শেষে নাটকের নাম শুনে তা বাতিল করেছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী।
ঘরে-বাইরে এত ধরনের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ‘নবান্ন’-এর যে ঢেউ, আরও নির্দিষ্ট করে বললে, গণনাট্য আন্দোলনের যে ঢেউ লেগেছিল বাঙালির সংস্কৃতি-মানসে, তা আগামীদিনের পথচলার এক সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিল। ‘নবান্ন’-এর মতো বিরাট ক্যানভাসের আর কোনও প্রযোজনা না হলেও জনগণের নাটক চলেছে তার নিজের নিয়মেই, তৈরি হয়েছে ‘জীয়ন কন্যা’-র মতো নাটক, সে-ও বিজন ভট্টাচার্যেরই রচনা। স্বাধীনতা-লাভের পরপরই ১৯৪৮ সালে যখন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে স্বায়ত্তশাসিত ভারতের নবনিযুক্ত সরকার, গণনাট্য সংঘও ‘বেআইনি’ ঘোষিত হল, তিনবছর চলেছিল এই নিষেধাজ্ঞা। ‘নবান্ন’-এর অন্যতম নির্দেশক শম্ভু মিত্র ততদিনে নিজের দল ‘বহুরূপী’ গড়ে ফেলেছেন, বিজন ভট্টাচার্যও ১৯৪৯-৫০ সাল নাগাদ গণনাট্য সংঘ থেকে বেরিয়ে এসে গড়েছেন ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’। কিন্তু সে ভাঙন ঘটেছে ইতিহাসের নিয়ম মেনেই। তাই, এই সময়েও দিব্যি রাষ্ট্রীয় চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে নাটক রচিত হয়েছে, একনিষ্ঠ পার্টিকর্মীদের সাহসী সহায়তায় পাড়ায় পাড়ায় অভিনীত হয়েছে সেসব নাটক। গীতিকার সলিল চৌধুরীর পাশাপাশি উত্থান ঘটেছে নাট্যকার সলিল চৌধুরীরও, ‘সংকেত’ ও ‘জনান্তিকে’-র মতো নাটক লিখছেন তিনি, সে নাটকে অভিনয় করেছেন সাধনা রায়চৌধুরী, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দিরা কবিরাজ, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়দের মতো শিল্পীরা।
-: আরও শুনুন :-
‘অনুদান হারানোর ভয়েই কেউ কেউ নীরবতা শ্রেয় মনে করছেন’
রাস্তার মোড়ে পাহারায় থাকতেন পার্টির কমরেডরা, পুলিশের গাড়ির শব্দ এলেই তাঁরা এসে খবর দেবেন, কলাকুশলীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা হবে পাড়ারই কোনও কমরেডের বাড়িতে – হ্যাঁ, এভাবেও এ কলকাতার বুকে নাটকের অভিনয় হয়েছে একসময়ে।
১৯৫১ সালে রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল, সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশ নিল কমিউনিস্ট পার্টি, কিন্তু নাটকের উপর থেকে নজরদারির কোনও কমতি নেই। ১৯৫২ সালে লালবাজার থেকে গণনাট্য সংঘের ধর্মতলা স্ট্রিটের অফিসে চিঠি দিয়ে চেয়ে পাঠানো হয়েছিল কয়েকটি পাণ্ডুলিপি, সে তালিকায় তুলসী লাহিড়ীর নাটক থেকে শুরু করে ‘রক্তকরবী’, ‘ছাগল’, ‘সংকেত’, এমন নানা নাম ছিল। প্রতিবাদে অরুণ রায় ও সজল চৌধুরী সম্পাদিত ‘থিয়েটার’ পত্রিকায় সম্পাদকীয় লেখা হল – “নাট্যশালায় কোন নাটক প্রদর্শিত হবে তার শেষ রায় দেবেন নাট্যশিল্প কর্মীরা বা নাট্যানুরাগী জনসাধারণ নয়, নাটক বাছাই করবেন লালবাজারের পুলিশ অফিসার। হতভাগ্য বাংলা দেশ! আরও ভাগ্যহীন বাংলার নাট্যকারবৃন্দ! বহু বিনীদ্র রজনী ও বহু বৎসরের আয়াসসাধ্য সাধনার ফলে যে নাটকের সৃষ্টি হ’ল সেন্সরের একটি কলমের খোঁচায় তা ব্যর্থ রচনা বলে পরিত্যক্ত হতে পারে।” একইসঙ্গে সম্পাদকীয়র পাতায় আহ্বান জানানো হল, ১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ সরকার-কর্তৃক পাশ হওয়া নাট্যাভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন প্রত্যাহারের জন্য জন-আন্দোলন গড়ে তোলার। মনে রাখা ভালো, এই আইনের জোরেই ১৮৭৬ সালের ৪ মার্চ ‘সতী কি কলঙ্কিনী’ প্রহসন অভিনয়ের দিনে তৎকালীন কলকাতার ডেপুটি কমিশনারের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ‘গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে’র উপেন্দ্রনাথ দাস, অমৃতলাল বসু, মতিলাল সুর, প্রমুখ নাট্যব্যক্তিত্ব। ওই ১৯৫২ সালেই স্বাধীনতা দিবসের দিনে শ্রীরঙ্গম থিয়েটারের মঞ্চে নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীও তাঁর অভিভাষণে স্পষ্ট বললেন – “ইংরাজদের আমলে পুলিশ দারোগার উপর নাটক বিচারের ভার ছিল – আজ পাঁচ বছর ‘স্বাধীনতার’ পর সেই আইন পুরা মাত্রায় বজায় আছে কেন?”
মতাদর্শগত বিরোধের কারণে একদিন যিনি ‘নবান্ন’-কে তাঁর থিয়েটারকক্ষে জায়গা দেননি, সেই শিশিরকুমার কিন্তু শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনও আপসের রাস্তায় হাঁটতে রাজি ছিলেন না – ঠিক এমনই ছিল বাংলা নাটকের ঐতিহ্য। সেখানে শিল্প ছিল, শিল্পের কঠোর সমালোচনা ছিল, প্রতিনিয়ত ভাঙনের পরম্পরা ছিল, কখনও-সখনও দেখা গিয়েছে চূড়ান্ত স্ববিরোধিতাও, কিন্তু পাশাপাশিই ছিল বিপদের মুহূর্তে পাশে দাঁড়ানোর মানবিক আবেদন। দুদশক পরে, বাংলায় যখন পুলিশি সন্ত্রাসের চূড়ান্ত, তখনও নাট্যদর্শক দেখেছেন, কার্জন পার্কে পুলিশের হাতে নাট্যকর্মী প্রবীর দত্তের হত্যার পর আজীবন পরস্পর-বিরোধী দুই নাট্যব্যক্তিত্ব উৎপল দত্ত এবং বাদল সরকারকে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদে সামিল হতে। ঘটনার দিন নাটকের মহড়া বন্ধ রেখেছিলেন ‘নান্দীকার’-এর অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। মৃণাল সেনের মতো প্রবীণ থেকে শুরু করে অসিত বসু বা নবারুণ ভট্টাচার্যের মতো তরুণ শিল্পীরা সকলেই সেদিন পথে নেমেছিলেন রাষ্ট্রীয় এই হত্যার বিরুদ্ধে।
রাষ্ট্রবিরোধী নাটক প্রযোজনায় যাঁর নাম প্রথম দিকেই থাকবে, সেই উৎপল দত্ত একসময়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন গণনাট্যের প্রযোজিত নাটকের বিষয়বস্তু নিয়ে। মানুষের কাছে পৌঁছনোর প্রশ্নে জনপ্রিয় বিষয়ে কাজ করাকে তিনি মনে করেছিলেন প্রয়োজনীয়, সেখানে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেনা পাওনা’-র মতো উপন্যাসও তাঁর কাছে সামন্ততন্ত্র-বিরোধী, অতএব, মঞ্চস্থ হওয়ার যোগ্য। নিজের এই আদর্শে তিনি কতখানি অবিচল ছিলেন, ১৯৬৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, ‘কল্লোল’ করার ‘অপরাধে’ ভারত রক্ষা আইনে তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা তারই সাক্ষ্য দেয়।
১৯৪৪ সালে ‘নবান্ন’ যে ঢেউ তুলেছিল, কুড়ি বছর পার করে এসে ‘কল্লোল’ আরেক ঢেউ তুলল নাট্য আন্দোলনের আকাশে, আক্ষরিক অর্থেই। শুধু নাট্যকারকে গ্রেপ্তার করেই ক্ষান্ত হল না সরকার, বিজ্ঞাপন বন্ধের মতো সমস্ত রকমের পদ্ধতি অবলম্বন করা হল নাটক বানচালের চেষ্টায়, কিন্তু ঘটল সম্পূর্ণ উল্টো ঘটনা, লাভের মধ্যে প্রবল জনপ্রিয় হয়ে গেল ‘চলছে, চলবে’ স্লোগান। উৎপল দত্তের গ্রেপ্তারির প্রতিবাদে উত্তাল হল সংস্কৃতি জগত, একমাস পেরোনোর আগেই আরও এক নাট্যব্যক্তিত্ব গ্রেপ্তার হলেন, উৎপলেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু জোছন দস্তিদার। তাঁর নাটক ‘অমর ভিয়েতনাম’-এর অভিনয় বন্ধ করার তখনও অবশ্য দুবছর বাকি।
আসলে, এমন নজির স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলা নাট্য ইতিহাসে কম নেই। নাটক লেখা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় ফরমান জারি করে তা বন্ধও হয়েছে, সে আদেশের বিরোধিতায় রাস্তাতেও নেমেছেন শিল্পীরা। খুব বেশিদিনের কথা নয়, এই পশ্চিমবাংলাতেই আগের সরকার যখন ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ বা ‘পশু খামার’-এর শো বন্ধ করে, তখনও গর্জে উঠেছেন নির্ভীক শিল্পীসমাজ।
আবার, একইসঙ্গে দেখা গিয়েছে ঠিক অন্য চিত্রও। সে চিত্র পিঠ বাঁচানোর। ১৯৭৪-এ প্রবীর দত্তের হত্যার পর ঠিক যেভাবে রাষ্ট্রপন্থী কথা বলতে দেখা গিয়েছিল শম্ভু মিত্রের মতো ব্যক্তিত্বকে, বা, ২০২৩ সালের ভারত রঙ্গ মহোৎসবে এই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্য প্রযোজনা ‘তিতুমীর’-কে আমন্ত্রণের পরও অন্যায় কারণ দেখিয়ে নাটক করার অনুমতি দেওয়া হল না দেখেও যেভাবে চুপ থাকলেন বাংলার অন্যান্য আমন্ত্রিত নাট্যগোষ্ঠীরা।
দুর্ভাগ্যজনক যা, তা হল, গত এক দশকে এই ‘অন্য চিত্র’টিই প্রভাবশালী চিত্র হয়ে উঠছে বাংলার নাট্যবৃত্তে। আর, সাম্প্রতিক যা ঘটল বা ঘটতে চলেছে, তা যেন এই ধারণায় সিলমোহর দিল।
কুশলীদেরই এখন বেছে নিতে হবে, ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে তাঁরা মানুষের পক্ষ নেবেন কি-না।