জাদুকর জাকির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। স্বপ্ন উস্তাদ জাকির হুসেন হয়ে ওঠার। বাঙালি ঘরের যে ছেলে তবলায় হাত রেখেছে, সেই-ই মনে মনে এই স্বপ্ন লালন করেছে। জাকির হোসেন যেমন এক বিদ্রোহীর নাম, তেমন এই স্বপ্নের ফেরিওয়ালাও। লিখছেন সুমন্ত বসু।
আশি-নব্বইয়ের দশকে বাঙালি মধ্যবিত্তের বাড়িতে সরস্বতীর কৃপাধন্য না হওয়া এক মহাপাপ বলে গণ্য হত। আমরা হয়তো এখনও বিশ্বাস করি যে সরস্বতীর উঠোন পেরিয়ে তবেই লক্ষ্মীর রাজপ্রাসাদে ঢুকতে হয়। তাই হয় লেখাপড়া অথবা গানবাজনা, নাচ, আবৃত্তি, আঁকাজোকা- কোনও একটা পথে আগে সরস্বতীর কৃপালাভ করতেই হবে। তাই আমিও ছোটবেলা থেকে লক্ষকোটি মধ্যবিত্ত বঙ্গসন্তানের মতোই তবলা শিখি। যদিও বেশিদিন এই সুঅভ্যাস আমি বরদাস্ত করিনি। আমার বাবা আমাকে সফল তবলিয়া করার চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি। দস্তুর মতন ফারাক্কাবাদ ঘরানায় উস্তাদ সাবির খান সাহেবের কাছে নাড়া বাঁধিয়েছিলেন। তবুও বুঝতেই পারছেন যে, চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি।
তবলার সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সেই কালযাপন আমায় এইটুকু বুঝিয়েছিল যে, এই যন্ত্রের শরীর আস্তে আস্তে আমার শরীরে ঢুকে আসছে। তবলার বোল আগে নিজের ভেতরে বাজতে হয়। তারপর পরিশ্রম করে করে আপনার ভেতরে বাজতে থাকা সেই বোল বাণীকে তবলায় সুর কিনার আর গাবের ওপর বাজাতে হয়। এই আশ্চর্য কর্মটি যোগ্যতা অনুযায়ী করতে গিয়ে যে মুখটা ভেসে উঠত, সেই মানুষটা আজ আর নেই।
সমস্ত যন্ত্রেরই একটা ইতিহাস থাকে। তবলার তো আছেই। সংগীতের দুনিয়ায় বিভিন্ন যন্ত্রের কৌলীন্য আছে। তবলা কিন্তু কৌলীন্যে পিছিয়ে পড়া এক যন্ত্র। আগেকার দিনে কেষ্টবিষ্টুদের আসরে সারেঙ্গি ও তবলা দাঁড়িয়ে বাজানোর প্রথা ছিল। তবলাকে তখন একক বাদ্যযন্ত্র নয়, বরং যন্ত্রানুষঙ্গ বলা হত। মূল কোনও প্রকার সংগীত পরিবেশিত হতে গিয়ে তাল বা ঠেকা দেবার অনুষঙ্গ মাত্র। আমাকেও শুরুর সেই দিনগুলোতে ‘ছাগলের পেছন বাজানোর লোক’ এই কথা শুনতে হয়েছে। সংগীতের রাজবাড়িতে দুয়োরানির ছেলে এই তবলা, কিন্তু সে তার অধিকারের লড়াই ছাড়েনি। সে ক্রমে ক্রমে একক বাদ্যযন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বহু জ্ঞানী গুণী পণ্ডিত-উস্তাদের অনলস সাধনায়, পরিশ্রমে।
তবে একজন ছিলেন, যিনি জাদুকরের মতন সেই যন্ত্রের গায়ে পাখা লাগিয়ে তাকে তরতর করে অনন্ত আকাশে সদর্পে উড়িয়েছেন। আদুর গায়ে অবহেলায় উঠোনে বসে থাকা সেই দুয়োরানির ছেলেটির গায়ে যুবরাজের বেশ পরিয়েছেন। তিনিই ইস্রাফিলের শিঙ্গাতে মহা-হুঙ্কার দিয়েছিলেন, হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে বলেছিলেন, “আমি চির-উন্নত শির।” তিনি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবানবুকে পদচিহ্ন এঁকে দেবার কলজে তিনিই রাখেন। তিনি নায়ক। তিনি পথিকৃৎ। তিনি সংকীর্ণতার প্রকাণ্ড পাথর সরিয়ে সংগীতকে অন্য এক মোহনায় মিশিয়েছেন। তিনি উস্তাদ জাকির হোসেন।
জাকির নামের মানে যিনি আল্লাহকে সর্বদা স্মরণ করেন। তিনিই তো ছিলেন, যাঁর একটা তেরেকেটে বাংলার ঘরে ঘরে লক্ষ জাকিরের জন্ম দিয়েছে। আমরা ভেতরে ভেতরে সব্বাই জাকির হোসেন হতে চেয়েছি। তিনি সূর্যের আলো হয়ে আমাদের মতন কোটি কোটি নাম না জানা পথের ঘাসফুলকে ফুটিয়ে আকাশের দিকে তাকাতে শিখিয়েছেন। এক স্পর্ধার নাম উস্তাদ জাকির হুসেন। এক বিপ্লবের নাম উস্তাদ জাকির হুসেন।
তিনি লয়দার। লয়কে কীভাবে ভেঙে দেখতে হয়, কীভাবে লয়ের গর্ভে বাজনার আত্মা শিশুর মতন ঘুমিয়ে থাকে, কীভাবে সম এসে সেই শিশুর মুখে তীক্ষ্ণ প্রসবের কান্না এনে দেয়, এসব তিনিই জানতেন আর আমাদের মতন মন্ত্রমুগ্ধদের জানাতেন।
লয় মানে কাল। মৃত্যু। সে আসবেই। কিন্তু আমি নিশ্চিত, কাজ সারার আগে সেও একবার নির্ঘাত থমকে দাঁড়াবে আর বলবে, “…বাহ্ উস্তাদ!” উত্তরে আমরা সব্বাই বলব, “আরে হুজুর বাহ তাজ বলিয়ে!!”