মিছিল বা প্রতিবাদের নির্দিষ্ট কিছু দাবি-দাওয়া নিশ্চিতই থাকে। তা পূরণের লক্ষ্যেই মানুষ সমবেত হয়। তবে তার পাশে পাশে জন্ম নিতে থাকা এই সাংস্কৃতিক চিহ্নগুলোও কিন্তু মনে রাখার মতোই। সময়ের প্রাপ্তি হিসাবে থেকে যায়, গান-কবিতা-স্লোগান। আন্দোলন যদি নতুন স্বরের জন্ম না দেয়, তবে আর কবে?
অন্ধকার সময়ে কি গান হবে না? হবে। হবে, অন্ধকার সময়েরই গান। ব্রেখটের এই কথা চিরকালীন। অন্ধকার তো নানা পরতের অর্থ বহন করে। আর তাই যখন সমাজে অন্ধকার নেমে আসে, যখন ঘটনার আকস্মিকতায় স্বর রুদ্ধ হয়ে যায় প্রায়, তখন সেই কণ্ঠেই জেগে ওঠে নতুন গান। সমসাময়িক বাংলায় ক্ষুব্ধ মানুষ যখন বিচার চাইতে পথে নামছেন, তখনও তাঁদের সঙ্গী হচ্ছে সুর। সুরের হাত ধরে পথচলা মিছিল জন্ম দিচ্ছে নতুন দৃশ্যের। তখন দেখা যাচ্ছে, যে রোম্যান্টিক কণ্ঠ এই ক-দিন আগেও মোহিত করেছে সকলকে, সেই কণ্ঠই এখন আন্দোলিত করছে, হয়ে উঠছে প্রতিবাদের আশ্রয়।
আরও শুনুন: পিতৃতন্ত্রের কারার লৌহকপাট ভাঙার ডাক, সময়ের বদলে নতুন অর্থ পেল নজরুলের গান
‘আর কবে?’ – অরিজিৎ সিংয়ের নতুন গান এখন ফিরছে প্রায় সব বাঙালির মুখে মুখে। সাম্প্রতিক আর জি কর কাণ্ডের প্রেক্ষিতেই এ গান বেঁধেছেন অরিজিৎ। সমসময়ের প্রতি শিল্পীর যে দায় ও দায়িত্ববোধ তারই এক চিহ্ন এই গান। গোটা দেশের গানের জগতেই বর্তমানে, অরিজিৎ সিং রোম্যান্টিক কণ্ঠের রাজা হিসাবেই পরিচিত। মেইনস্ট্রিম সিনেমার রোম্যান্টিক হিরোর কণ্ঠে তাঁর গান না থাকলেই যেন নয়। অন্তত বিগত কয়েক বছরে তা যেন রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে, সময়ের চরিত্রটাই যে আলাদা। যে সময় ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ, যে সময় চিৎকার করে উঠতে চাইছে, সেই সময় অরিজিৎ ধরা দিয়েছেন একেবারে নতুন রূপে। তাঁর সেই রোম্যান্টিক কণ্ঠে যে প্রতিবাদের স্বর, তা সময়েরই দিকচিহ্ন হয়ে উঠেছে। আসলে সময়ের ভিতরে যখন নানা ঘাত প্রতিঘাত চলতে থাকে, তখন তা নানা আঙ্গিকেই প্রকাশ পায়। গান নিঃসন্দেহে সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। কেননা সুরের হাত ধরে বহু মানুষ একত্রিত হতে পারেন।
আরও শুনুন: প্রতিবাদের মাশুল! রাস্তায় ঘিরে ধরল দুষ্কৃতীরা, ভয় না পেয়ে পালটা লড়াই করেছিলেন রাজলক্ষ্মী
বাংলার প্রতিবাদী গানের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। লালন যখন বলেন, ‘জাত গেল জাত গেল বলে, এ কী আজব কারখানা!’ তখনও তিনি সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধেই সরব। চৈতন্যদেবের কীর্তন তো সুর ছুঁয়ে মানবন্ধনেরই অন্য রূপ। বাংলার জাগরণ আর সেই কীর্তনের সুর এমন ওতপ্রোত জড়িত যে, বাঙালির যে কোনও জনজাগরণে মিশে থাকে কীর্তনের চাল। বাংলার লোকগান কখনও আক্ষেপেই সামাজিক অন্যায়ের ইস্তেহার হয়ে উঠেছে। ‘চল মিনি আসাম যাব’- যিনি গেয়ে উঠছেন তিনি তো অন্যায়ের, শোষণের ছবিই তুলে ধরছেন। প্রবল প্রতাপান্বিত রাজশক্তি কেঁপে উঠেছে চারণকবি মুকুন্দদাসের গানে। ‘মা, তোমরা বীরধাত্রী, তোমাদের সন্তান কি ভীরু কাপুরুষ হবে?’ – লক্ষ মানুষের মনে দ্রোহের মশাল জ্বালিয়ে দিতে পেরেছিলেন তিনি গানে-সুরে। পরবর্তী সময়েও এই ধারা বজায় থেকেছে। রবীন্দ্রনাথের গান বাঙালির আশ্রয়। বাংলার দুর্যোগের দিনে সেই রবীন্দ্রনাথও বাঙালিকে সুরে-সুরে এক সুতোয় গেঁথেছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামের গান বাঙালির বিদ্রোহী সত্তাকে জাগিয়ে তুলেছে। যে গানকে একেবারেই প্রেমের বলে ধরা হয়, তেমন অবিস্মরণীয় গানও রচনা করেছেন তাঁরা। পাশাপাশি সময়ের প্রয়োজনে তাঁদের কলমে এসেছে সময়ের ভাষ্য। গান হয়েই তা লক্ষ মনকে জাগিয়ে তুলেছে। পালটেছে সময়পর্ব, আর হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, মৌসুমী ভৌমিকের গান বাঙালির প্রতিবাদের ভাষা হয়ে গিয়েছে।
আরও শুনুন: ‘আমাদের বোনের বিচার চাই’… খেলার আনন্দেও প্রতিবাদ ভুলল না বাঙালির ফুটবল
আসলে ক্ষুব্ধ সময়ে অনেকরকম প্রাপ্তি থাকে। মিছিল বা প্রতিবাদের নির্দিষ্ট কিছু দাবি-দাওয়া নিশ্চিতই থাকে। তা পূরণের লক্ষ্যেই মানুষ সমবেত হয়। তবে তার পাশে পাশে জন্ম নিতে থাকা এই সাংস্কৃতিক চিহ্নগুলোও কিন্তু মনে রাখার মতোই। প্রতিটি আন্দোলন নতুন স্লোগানের জন্ম দেয়। যেমন নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে যে মিছিল হচ্ছে কলকাতায়, তাতে স্লোগানে যোগ হয়েছে লিঙ্গসাম্যের কথাও। আবার সময়েরই নিয়মে কোনও কোনও গুণী শিল্পীর গান বা রচনা সেভাবে এই সময়ে মুখরিত হয়ে ওঠেনি। এই গ্রহণ-বর্জনের ভিতর দিয়েই সময় তার নিজস্ব চরিত্র অর্জন করে। এবারের আন্দোলনও তার ব্যতিক্রম হল না। যে লক্ষ্যে মানুষ পথে নামছেন, তা অর্জন করতে কত পথ অতিক্রম করতে হবে, সে উত্তর সময়ই জানে। তবে সময়ের প্রাপ্তি হিসাবে থেকে যায়, গান-কবিতা-স্লোগান। আন্দোলন যদি নতুন স্বরের জন্ম না দেয়, তবে আর কবে?