শব্দ দিয়ে সেই গভীর গহন ভালোবাসারই তো খোঁজ করেছেন রুশদি, যে ভালোবাসা সবরকম নিপীড়ন, উগ্রতা আর আক্রমণের প্রতিরোধ। সে প্রতিরোধে ভর করেই তো স্বাধীন মতপ্রকাশের সাহস জড়ো করা যায়। নিজের প্রতি, আত্মজনদের প্রতি, লেখার প্রতি, বইয়ের প্রতি, সর্বোপরি প্রতিরোধের প্রতি ভালোবাসা যেন বর্ম হয়ে উঠল রুশদির। আর শব্দই হয়ে উঠল সেই ভালোবাসার বাহক।
“সেই যে রত্নাকর ছিল, দস্যুতা জীবিকা ছিল তার
আমার জীবিকা শব্দ, প্রেম ছাড়া শব্দ আছে আর?”
জয় গোস্বামীর কবিতার এ পঙ্ক্তি শুনলে রুশদিও হয়তো বলতেন, এ তো তাঁরও কথা। যাঁর বরাবরের বিশ্বাস, “Love is a force. That in its most potent form, it can move mountains, Love can change the world.” শব্দ দিয়ে সেই গভীর গহন ভালোবাসারই তো খোঁজ করেছেন রুশদি, যে ভালোবাসা সবরকম নিপীড়ন, উগ্রতা আর আক্রমণের প্রতিরোধ। সে প্রতিরোধে ভর করেই তো স্বাধীন মতপ্রকাশের সাহস জড়ো করা যায়। পনেরোবার ছুরির আঘাতে যখন গলা জখম, যকৃত ও অন্ত্রে জখম, হাতের তালু এফোঁড় ওফোঁড়, একটা চোখ স্রেফ নেই, তারপরেও জীবনে বিশ্বাস রাখা যায়। সেই সময়েও রুশদি মনে করে নেন, ২৭ সেকেন্ড ধরে আততায়ী তাঁর চোখে, ঘাড়ে, বুকে ছুরির আঘাত চালিয়ে গিয়েছে। আর শেক্সপিয়রের ১৩০ নম্বর সনেট পড়তে ২৭ সেকেন্ডই লাগে। যে সনেটের প্রথম পঙ্ক্তিতেই চোখের উল্লেখ। আর শেষে স্বীকারোক্তি- সূর্যের মতো চোখ নয়, প্রবালের মতো রক্তিম অধর নয় প্রেয়সীর, তবু স্বর্গের দিব্যি দিয়ে বলা যায়, সে প্রেম দুর্লভ। মৃত্যুর বিছানায় শুয়েও যে মানুষ সেই দুর্লভ প্রেমের কথা ভাবেন, তাঁর শব্দেরা তো প্রতিরোধের মতো জেগে থাকবেই।
আরও শুনুন:
ডাকলে বাঙালি যে ঠাকুরের দেখা পায়, তিনিই রবীন্দ্রনাথ
অথচ, তাঁর কণ্ঠরোধ করার জন্যেই তো এত আয়োজন। তাও আজ থেকে নয়, ৩৪ বছর ধরেই জারি সেই ধারাবাহিক আক্রমণ। কিন্তু কোনও ফতোয়াই যে কোনও দিনই অক্ষরকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, নিজের গোটা জীবন ধরে যেন সে কথাই লিখে চলেছেন সলমন রুশদি। দুষ্কৃতীর ছুরির আঘাত সয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে আরও একবার, এই ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়েছেন তিনি। সব মৌলবাদকে উপেক্ষা করে দিনের আলো দেখেছে রুশদির সেই বইটি, ছুরি হামলার সময় যে বইয়ের নির্মাণ ছিল শেষের মুখে। ঘটনাচক্রে যার শিরোনামেই রয়ে গিয়েছে ‘বিজয়’ শব্দটি। ‘ভিকট্রি সিটি’ নামে সে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র পম্পা কম্পনা রাজরোষে পড়ে ভয়ংকর শাস্তির নিদান লাভ করে। তার দুই চোখে গেঁথে দেওয়া হয় লোহিততপ্ত শলাকা। নিয়তি হয়তো এই, যে শাস্তিতে রুশদির নিজের ছিল সবচেয়ে বেশি ভয়, সেটাই তাঁর নিজের জীবনে ঘটে যায়।
কিন্তু ভয়ের সঙ্গে তো কত বছর ধরেই সহবাস করছেন লেখক। ১৯৮৯ সালের ভ্যালেন্টাইন ডে’র দিনে– ‘স্যাটানিক ভার্সেস’-এর বিরুদ্ধে আয়াতোল্লা খোমেইনির ফতোয়া জারি হওয়ার পরে সলমন রুশদিকে হারিয়ে যেতে হয়েছিল। জোসেফ আন্তন ছদ্মনামে বিভিন্ন জায়গায় তখন আত্মগোপন করেছেন রুশদি, যার ছায়া ২০১২ সালে বেরোনো রুশদির স্মৃতিকথা জোসেফ আন্তন-এ। আত্মগোপনের জীবনই যেন শিরোধার্য হয়ে গিয়েছিল রুশদির ক্ষেত্রে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর লেখারা দিনের আলো দেখেছে। আস্তে আস্তে আলোয় ফিরেছেন রুশদি নিজেও। বক্তৃতা দিয়েছেন, বেড়াতে গিয়েছেন, পাঠকদের মুখোমুখি হয়েছেন, এমনকি বিয়েও করেছেন আবার। তাঁর কথায়, “লোকে আমার সঙ্গে মিশতে ভয় পেত। তাই আমি ভেবেছিলাম, সেই ভয় ভাঙানোর একটাই উপায় আছে। আর তা হল, আমি ভয় পাইনি এ কথা জানানো।” তিলে তিলে তিনি যে ভয়ের টুঁটি চেপে ধরেছিলেন নিজের মুঠিতে, সেখানেই অতর্কিতে হামলা চালাল এক ছুরি। ফের ফিরিয়ে দিতে চাইল পুরনো ত্রাস। অথচ সেই আঘাত সামলে নিয়ে যে রুশদি ফিরে এলেন, আততায়ীর প্রতি তিনি জিইয়ে রাখলেন এক স্পর্ধিত অবজ্ঞা। যিনি ছুরির সামনেও পিঠ ফেরাননি, পিঠে কোনও ক্ষতচিহ্ন ধারণ করতে যিনি নারাজ, তিনি শরীরে রেখে দিলেন তাঁর ‘মরা চোখ’। সমস্ত দেখার চেয়েও বেশি দৃশ্যমানতা নিয়ে কালো কাচের আড়ালে স্থির রইল সেই আঘাতের অভিজ্ঞান। আর আততায়ীকে তিনি বইয়ে সম্বোধন করলেন ‘দ্য এ’ বলে। ‘এ’ মানে গাধা বা অ্যাস, খুনে বা অ্যাসাসিন যা কিছু হতে পারে। নামহীন করে তার ব্যক্তিপরিচয়টাকেই পাত্তা দিলেন না রুশদি। যেন বুঝিয়ে দিলেন, যে ঘৃণা এবং ভয়ে তাঁকে ডুবিয়ে দিতে চাওয়া হয়েছে, তাকেই তিনি নস্যাৎ করবেন, হামলাকারীর প্রতি ঘৃণাটুকুও বরাদ্দ না করে।
আরও শুনুন:
এত লেখার থেকে ডিম সেদ্ধ বিক্রি করলেও হত! ছোটদের সঙ্গে মশকরা রসিক বন্ডের
আর এখানেই ফের ইঙ্গিত রয়ে গেল সেই ভালোবাসার। নিজের প্রতি, আত্মজনদের প্রতি, লেখার প্রতি, বইয়ের প্রতি, সর্বোপরি প্রতিরোধের প্রতি ভালোবাসা যেন বর্ম হয়ে উঠল রুশদির। আর শব্দই হয়ে উঠল সেই ভালোবাসার বাহক। নিজের গোটা জীবন দিয়েই রুশদি জানিয়ে দিলেন, সেই ভালোবাসার বর্মে প্রতিটি লড়াকু মানুষের অধিকার।