‘বাড়িওয়ালি’ ছবিতে ঋতুপর্ণ-র নায়ক আদতে মফস্সলের দত্তবাড়ি। বনলতার সারাজীবনের যন্ত্রণা, নিঃসঙ্গতার ধুলো লেগে থাকে পলেস্তারা-খসা খিলান-বারান্দায়। শুটিং-এর মাঝে আলো জ্বলে উঠলে যেমন ক্ষণিকের জন্যে ঝলমলিয়ে ওঠে সেট, দত্তবাড়িতেও তেমনি একদিন রং করা শুরু হয়, শুটিং শুরুর আগে এই সাদা রং চড়ানোর দৃশ্য দেখে যখন চাকর বনলতাকে জানায়, এলোথেলো বনলতার অন্তরমহলের ধুলো ডিঙিয়ে যেন ক্ষণিকের জন্য জেগে ওঠে অকাল যৌবন। ‘এই সুযোগে তাও একটু বাড়িটা পরিষ্কার হচ্ছে, ভালই তো…’, এই বাড়ির পূর্বদিকে বনলতার ঘর। পশ্চিমে শুটিং। দীপঙ্করের নির্দেশে মাঝখানে ওঠে অস্থায়ী পার্টিশন। জীবনের পরিখাঘেরা পড়ন্ত যৌবনের রোজনামচা থেকে আর্ট ডিরেক্টর দেবাশিসের হাত ধরে বনলতা মাঝে মাঝে এসে পড়ে শুটিং-এ। আদতে নিজের জীবনের অন্য পিঠে। জ্যোৎস্না আর অন্ধকার বুকে বনলতার নিত্যসঙ্গী সেই বাড়িই- তার পাঁচ পুরুষের ভিটে। ঋতুপর্ণের নির্দেশনায় দেবজ্যোতি মিশ্রের আবহসঙ্গীত এই সিনেমায় আলাদা গুরুত্ব বহন করে। সিনেমার শুরুতে মলিন, জীর্ণ মূল ফটককে ব্যাকড্রপে রেখে বেজে ওঠে জীবনের মধুমাসের গান- ‘হল মধুমাসে বিয়া…’। শুকিয়ে যাওয়া চরের নিচে কয়েকদিনের জন্য যেন জেগে ওঠে সুবর্ণরেখার জল। একটি চলচ্চিত্রের সীমানার ভেতর দুটি জীবন, সিনেমার শেষ দৃশ্যে দেবাশিসের চিঠি পেয়ে বনলতা যখন জানতে পারে তাঁর বাড়ি দেখে মুগ্ধ হয়েছে শহুরে দর্শক, তাঁর মুখে ফুটে ওঠে হাসি, পরমহূর্তে তাঁর অভিনীত একমাত্র সিনটি ডিরেক্টর যখন এডিটে বাদ দিয়ে দেয় তখন কান্নায় ভেঙে পড়ে চিরদুঃখী ‘বাড়িওয়ালি’। পূর্বের ঘর আর পশ্চিমের মাঝে দীপঙ্করের তুলে দেওয়া সেই অস্থায়ী দেওয়াল আড়াল করে দেয় বনলতার ফেলে আসা জীবনকে; তার গোপন ইচ্ছের সংকটের স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকে বাড়ির পশ্চিমদিকটি।
ঋতুপর্ণের সিনেমায় নান্দনিকতার গাঢ় উদযাপনের ভেতর সামান্য বস্তুর এমন সূক্ষ্ম অনুভূতি নিয়ে চরিত্র হয়ে ওঠার নজির প্রথম দেখা যায় ‘উনিশে এপ্রিল’ সিনেমায়। অদিতির খাটের পাশে রাখা ডেট ক্যালেন্ডারের পাতায় উনিশে এপ্রিল- বাবার মৃত্যুদিনের চিত্রনাট্যে একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে মা ও মেয়ের সম্পর্কের দীর্ঘকালীন ফাটল। ‘উনিশে এপ্রিল’ জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর ঋতুপর্ণ ঘোষকে এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, অদিতির বাবার মৃত্যুদিন হিসেবে উনিশ তারিখটি বেছে নেওয়ার কোনও বিশেষ তাৎপর্য আছে কি-না? ঋতুপর্ণর উত্তর ছিল উনিশ হল এমন এক তারিখ যেদিনের পর ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে গেলেও তারিখের দুটি ডিজিটই পালটে যায়; আসলে আমি চেয়েছিলাম তারিখটা সম্পূর্ণ বদলে যাক, সম্পর্কটাও।
সিনেমার শুরুতে অদিতি আঠেরো থেকে উনিশ করে দেয় ক্যালেন্ডারের পাতা, বাকি চিত্রনাট্যে ক্যালেন্ডারের প্রবেশ ও প্রস্থান ক্যামেরার কারসাজিতে অদ্ভুতভাবে ধরছেন ঋতুপর্ণ, মা-মেয়ের প্রতিটি মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের সাক্ষী ক্যালেন্ডারে ঝুলে থাকা উনিশে এপ্রিল, রাত বারোটা বাজলে ফ্লাইট ক্যানসেল হওয়ায় বাড়ি ফেরে মা, মেয়ের টেবিলে আবিষ্কার করে ঘুমের ওষুধের স্ট্রিপ, অসহায়তার অন্ধকারে জ্বলে ওঠে আশঙ্কার আলো। মুখোমুখি বসে মা-মেয়ে। ক্যালেন্ডারের পাতা বদলে দেয় অদিতি, বদলে যায় ঋতুপর্ণের পার্শ্বচরিত্রদের সম্পর্কের সমীকরণ, স্ক্রিনে থেকে যায় সময়ের দাগ- ক্যামেরার ফোকাসে থেকে যায় সেই ডেট ক্যালেন্ডার।
‘ইটস আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ’ ছবিতে যেমন আলতার মতো মায়ার লাল ছাপ রেখে যায় জুজু’স পেটাল, ‘ফরেস্ট গাম্প’-এ যেমন মুহূর্তকে বন্দি করে একবাক্স চকোলেট, ‘দ্য পিয়ানো’ ছবির আত্মা যেমন বাঁধা কেবল পিয়ানোটিতে, বাংলা চলচ্চিত্রে তেমনই সোনার কাঠি-রুপোর কাঠি ঋতুপর্ণের প্রপেরা।
‘আবহমান’-এ ডিরেক্টরের চোখ রিলের রেলগাড়ি থেকে আচমকা খুঁজে পায় শিখার একটি ফ্রেম, ঠোঁটের কোণে জেগে ওঠে হাসি, যে শিখার সম্মুখ উপস্থিতি বিরক্তির কারণ ছিল অনিকেতের, ওই ফিল্মের স্ট্রিপে একটি ফ্রেম বদলে দেয় সবকিছু, শিখা থেকে শ্রীমতী হয়ে ওঠার পথ নির্মাণ করে ওই ফ্রেম, যে পথ দিয়ে গিরীশ ঘোষ-বিনোদিনীর বহুমাত্রিক সম্পর্ককে একুশ শতকের পর্দায় আনলেন ঋতুপর্ণ। ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ সিনেমায় অর্ণবের অপছন্দের অ্যাকোরিয়াম শেষ অবধি আমাদের সামনে নিয়ে আসে কাচের ভেতর বন্দি হয়ে থাকা ভাবনাদের। কাচের বাক্সে গণ্ডিঘেরা রঙিন মাছেদের মতো আমাদের সাবেকি খোলসে থাকা সামাজিক বেড়াকে অবলীলায় ডিঙিয়ে যান ঋতুপর্ণ, তাঁর রাজকীয় নির্মাণের ঘেরাটোপে কখনও দর্শক কেবলই মুগ্ধ হয়, পা দেয় তাঁর সাজানো চিত্রনাট্যের ঘেরাটোপে, কখনও বা স্বেচ্ছায় নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে তাঁর সম্মোহনের ছায়া থেকে। বাঙালির ঋতুপর্ণ তাই কেবলই চর্চিত বিষয়, ততটা আলোচিত নয়, চড়া মেকআপের স্তুতি কিংবা অযাচিত কৌতূহলই তাঁকে উপহার দিতে পেরেছে বাঙালি এত বছরে। তাঁর সিনেমায় মুহূর্ত বন্দি করার মুনশিয়ানা লুকিয়ে তাঁর চরিত্র নির্মাণে, অভিনেতার তূণীরে থাকা সংলাপ তিনি ভরেছেন নিজ হাতে, তাঁদের রাজবস্ত্রে কিংবা আভরণহীন সন্ন্যাসীবেশে সাজিয়েছেন তিনি নিজেই- এই সমস্ত চরিত্রদের নিয়ে আলোচনা হয়, অনালোচিত থেকে যায় বাড়ি-ক্যালেন্ডার-অ্যাকোয়ারিয়াম, যেন রাজার প্রাসাদের পাশে বসে আছে অভিমানী রাখাল, যার বাঁশিতে ধরা আছে চলচ্চিত্রের সরগমটি- ঋতুপর্ণ নিঃশব্দে এই চরিত্রদের সাজিয়েছেন, উপহার দিয়েছেন নৈঃশব্দ্যের সংলাপ। ব্যক্তিগত পরিসরে তিনি যতখানি একা, ততখানি একাকিত্বই যেন তিনি বুনে দিয়েছেন এইসব তথাকথিত ‘অমানবিক’ চরিত্রদের শরীরেও।…