সিনেমায় মুহূর্ত বন্দি করার মুনশিয়ানা লুকিয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের চরিত্র নির্মাণে, অভিনেতার তূণীরে থাকা সংলাপ তিনি ভরেছেন নিজ হাতে, তাদের রাজবস্ত্রে কিংবা আভরণহীন সন্ন্যাসীবেশে সাজিয়েছেন তিনি নিজেই- এই সমস্ত চরিত্রদের নিয়ে আলোচনা হয়; অনালোচিত থেকে যায় বাড়ি-ক্যালেন্ডার-অ্যাকোয়ারিয়াম; যেন রাজার প্রাসাদের পাশে বসে আছে অভিমানী রাখাল, যার বাঁশিতে ধরা আছে চলচ্চিত্রের সরগমটি… ঋতুপর্ণ-তর্পণে অর্পণ গুপ্ত।
মুহূর্ত জন্মের মতো চলে যায়। অন্ধ জাতিস্মর কিনারা করে উঠতে পারে না কিছুই। কাগজের দূরবীনে চোখ রেখে দেখে নেয় সোনাডাঙার মাঠ, তার ওপর চড়ুইভাতির রোদ, ধোঁয়া ওঠা রেলগাড়ি। গতজন্মের ভুলে যাওয়া স্মৃতি কিংবা বিস্মৃত অক্ষরের পাশে জুঁইফুলের চারা। অথচ ক্যামেরা আবিষ্কারের বহু আগে মানুষ শিখে গেছে বাঘবন্দি খেলা। মুহূর্তকে বেঁধে রাখার চেয়ে বাঘ বেঁধে রাখা সোজা। সেখানে কেবলই দৃষ্টি লাগে, শিকারির দৃষ্টি। জাতিস্মরের চোখ, মননের অমৃত রেকাব, মেধার তীক্ষ্ণ আলো সেখানে অপ্রাসঙ্গিক। সত্যজিৎ চিরাচরিত ব্যারিটোনে লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন বলে বাঙালিকে একটা গড় মোমেন্টস-এর ধারণা দিয়ে গেলেন। ঝুড়ি চাপা বেড়ালছানা দেখার মুহূর্তে অন্ধকার বলয়ে, গোল আলোর বৃত্তে ভেসে ওঠে দুর্গার মুখ, ওই এক মুহূর্তে অনন্তকালে সাজিয়ে ফেলেন সত্যজিৎ। ‘মহানগর’ সিনেমায় সদ্য চাকরি পেয়ে আরতি যখন শ্বশুরকে ফল আর টাকা দিতে যান শ্বশুরের সেই সংলাপ- “ফল রেখে যাও, টাকা আমি নেব না…”- আড়াই সেকেন্ডের সংলাপে ধরে ফেলে সমগ্র চলচ্চিত্রের একটি মিনিয়েচারকে, আসলে মুহূর্ত দিয়ে এখানে সত্যজিৎ বাঁধছেন একটি জোরালো সামাজিক বক্তব্য এবং একাধারে সেই মুহূর্তটিকেও বন্দি করছেন রুপোলি পর্দায়।
আরও শুনুন: ‘আপনার ফ্লোরে থাকা দরকার’ জ্বরে কাতর তরুণ মজুমদারের পাশে দাঁড়ালেন স্বয়ং সুচিত্রা
সত্যজিৎ পরবর্তী সময়ে নয়ের দশকের গোড়ায় বাংলা চলচ্চিত্রের যে ভাটার টান- মেধা-মননের ধার, যুক্তির তীব্রতার স্রোত দিয়ে সেই নদীর জড়তা ভেঙে দেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।
কিন্তু ঋতুপর্ণ-র সিনেমায় মনন-দর্শন সংক্রান্ত আলোচনায় যা কিছুটা কম আলোচিত, তা হল অতি সামান্য প্রপস-কে চরিত্র হিসেবে গড়ে-পিটে নিয়ে তা দিয়েই জালের মতো মুহূর্তকে ধরে ফেলার মুন্সিয়ানা। সত্যজিতের সিনেমার উদাহরণে একটি ফ্রেম, একটি চরিত্র, একটি সংলাপ যেভাবে মুহূর্ত বাঁধল, ঋতুপর্ণ-র সিনেমায় সাজানো, গুছানো, প্রমিত সেটের ভেতর থেকে সমগ্র গল্প বলার দায়িত্ব তুলে নেয় কখনও একটি হ্যান্ডিক্যাম, কখনও একটি রেনকোট, কখনও মফসসলের জমিদার বাড়ি, কখনও একটি ফিল্মের রিল, কখনও ডেট ক্যালেন্ডার। বাংলা চলচ্চিত্রে মায়াবিভ্রম ঘটান ঋতুপর্ণ, তাঁর চরিত্রদের গায়ে এক কণা ধুলো জমে না কোনওদিন। সেই পেলব, কোমল অথচ ভণিতাহীন চরিত্রেরা যে মঞ্চ নির্মাণ করেন, সেই মঞ্চেই কখনও নায়ক হয়ে ওঠে এই সব জড় চরিত্রেরা, চিন্ময়ী রূপদানের জিয়নকাঠি ধরে থাকেন স্বয়ং ঋতুপর্ণ।
আরও শুনুন: মতবিরোধ সত্ত্বেও সৌজন্য, সত্যজিৎ-মৃণাল সম্পর্ক দিশা দেখায় ‘দিকভ্রষ্ট’ বাঙালিকে
‘উৎসব’ সিনেমায় কথক জয়ের সঙ্গী তাঁর নতুন বন্ধু একটি হ্যান্ডিক্যাম। শুরু থেকেই কখন যেন ঋতুপর্ণের ক্যামেরা থেকে ঢুকে পড়ে জয়ের হ্যান্ডিক্যামে। প্রথম সিনে একচালা প্রতিমা প্রসঙ্গে জয়ের মুখ দিয়ে ঋতুপর্ণ বলেন- “এ বাড়ির প্রতিমা চিরকালই ট্র্যাডিশনাল। একচালার। সুকুমার সেনের বইতে মোস্ট প্রবাবলি আছে একচালা ঠাকুর মানেই যৌথ পরিবারের প্রতীক।” পুজো শুরুর আগে জয় বাড়ির সকলকে ডাকে, তার নতুন ক্যামেরায় ফ্যামিলি ফটো তোলার জন্য। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ছড়িয়ে থাকা পারিবারিক কলহ, সম্পর্কের জটিলতার কুচি যেন মসৃণভাবে উৎসবের চাঁদোয়ার নিচে নিয়ে আসেন ঋতুপর্ণ, আর সমস্তটুকু ফ্রেমবন্দি করার অলিখিত দায়িত্ব তুলে নেয় ঋতুপর্ণর চরিত্র হয়ে-ওঠা সেই হ্যান্ডিক্যাম। শেষ পর্যন্ত নায়কের বিদায়দৃশ্যে যেমন পড়ে থাকে স্মৃতি, তেমনই আমেরিকায় পড়তে যাওয়া জয়ের সঙ্গী হ্যান্ডিক্যামটি মামাবাড়িতে রেখে যায় পুজোর ভিডিও, একাকী-নিঃসঙ্গ বাড়িতে টিভিতে শুরু হল ফার্স্ট সিনের রিপ্লে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজে- ‘ফেলে যেতে চায় এই কিনারায় সব চাওয়া সব পাওয়া…’- আদতে উৎসবের স্মৃতি, যাকে আঁকড়ে আরও ক’টা দিন বেঁচে থাকবে কিছু মানুষ। সচেতনভাবে পরিচালক হিসেবে ঋতুপর্ণ ঘোষ ক্যামেরার এই ট্রানজিশনটি ঘটালেন। জয়ের চোখ দিয়ে, তাঁর সদ্য হাতে পাওয়া ক্যামেরা চারদিনের উৎসবে ফেলে গেল একচালার যৌথতা। অথচ সে কেবল জড় লেন্স নয়, পারিবারিক অন্ধকারকে সযত্নে এডিট করার দায় নিয়েই সে মায়ের অতীত অস্বস্তিকে আড়াল করে।
‘বাড়িওয়ালি’ ছবিতে ঋতুপর্ণ-র নায়ক আদতে মফস্সলের দত্তবাড়ি। বনলতার সারাজীবনের যন্ত্রণা, নিঃসঙ্গতার ধুলো লেগে থাকে পলেস্তারা-খসা খিলান-বারান্দায়। শুটিং-এর মাঝে আলো জ্বলে উঠলে যেমন ক্ষণিকের জন্যে ঝলমলিয়ে ওঠে সেট, দত্তবাড়িতেও তেমনি একদিন রং করা শুরু হয়, শুটিং শুরুর আগে এই সাদা রং চড়ানোর দৃশ্য দেখে যখন চাকর বনলতাকে জানায়, এলোথেলো বনলতার অন্তরমহলের ধুলো ডিঙিয়ে যেন ক্ষণিকের জন্য জেগে ওঠে অকাল যৌবন। ‘এই সুযোগে তাও একটু বাড়িটা পরিষ্কার হচ্ছে, ভালই তো…’, এই বাড়ির পূর্বদিকে বনলতার ঘর। পশ্চিমে শুটিং। দীপঙ্করের নির্দেশে মাঝখানে ওঠে অস্থায়ী পার্টিশন। জীবনের পরিখাঘেরা পড়ন্ত যৌবনের রোজনামচা থেকে আর্ট ডিরেক্টর দেবাশিসের হাত ধরে বনলতা মাঝে মাঝে এসে পড়ে শুটিং-এ। আদতে নিজের জীবনের অন্য পিঠে। জ্যোৎস্না আর অন্ধকার বুকে বনলতার নিত্যসঙ্গী সেই বাড়িই- তার পাঁচ পুরুষের ভিটে। ঋতুপর্ণের নির্দেশনায় দেবজ্যোতি মিশ্রের আবহসঙ্গীত এই সিনেমায় আলাদা গুরুত্ব বহন করে। সিনেমার শুরুতে মলিন, জীর্ণ মূল ফটককে ব্যাকড্রপে রেখে বেজে ওঠে জীবনের মধুমাসের গান- ‘হল মধুমাসে বিয়া…’। শুকিয়ে যাওয়া চরের নিচে কয়েকদিনের জন্য যেন জেগে ওঠে সুবর্ণরেখার জল। একটি চলচ্চিত্রের সীমানার ভেতর দুটি জীবন, সিনেমার শেষ দৃশ্যে দেবাশিসের চিঠি পেয়ে বনলতা যখন জানতে পারে তাঁর বাড়ি দেখে মুগ্ধ হয়েছে শহুরে দর্শক, তাঁর মুখে ফুটে ওঠে হাসি, পরমহূর্তে তাঁর অভিনীত একমাত্র সিনটি ডিরেক্টর যখন এডিটে বাদ দিয়ে দেয় তখন কান্নায় ভেঙে পড়ে চিরদুঃখী ‘বাড়িওয়ালি’। পূর্বের ঘর আর পশ্চিমের মাঝে দীপঙ্করের তুলে দেওয়া সেই অস্থায়ী দেওয়াল আড়াল করে দেয় বনলতার ফেলে আসা জীবনকে; তার গোপন ইচ্ছের সংকটের স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকে বাড়ির পশ্চিমদিকটি।
ঋতুপর্ণের সিনেমায় নান্দনিকতার গাঢ় উদযাপনের ভেতর সামান্য বস্তুর এমন সূক্ষ্ম অনুভূতি নিয়ে চরিত্র হয়ে ওঠার নজির প্রথম দেখা যায় ‘উনিশে এপ্রিল’ সিনেমায়। অদিতির খাটের পাশে রাখা ডেট ক্যালেন্ডারের পাতায় উনিশে এপ্রিল- বাবার মৃত্যুদিনের চিত্রনাট্যে একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে মা ও মেয়ের সম্পর্কের দীর্ঘকালীন ফাটল। ‘উনিশে এপ্রিল’ জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পর ঋতুপর্ণ ঘোষকে এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, অদিতির বাবার মৃত্যুদিন হিসেবে উনিশ তারিখটি বেছে নেওয়ার কোনও বিশেষ তাৎপর্য আছে কি-না? ঋতুপর্ণর উত্তর ছিল উনিশ হল এমন এক তারিখ যেদিনের পর ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে গেলেও তারিখের দুটি ডিজিটই পালটে যায়; আসলে আমি চেয়েছিলাম তারিখটা সম্পূর্ণ বদলে যাক, সম্পর্কটাও।
সিনেমার শুরুতে অদিতি আঠেরো থেকে উনিশ করে দেয় ক্যালেন্ডারের পাতা, বাকি চিত্রনাট্যে ক্যালেন্ডারের প্রবেশ ও প্রস্থান ক্যামেরার কারসাজিতে অদ্ভুতভাবে ধরছেন ঋতুপর্ণ, মা-মেয়ের প্রতিটি মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের সাক্ষী ক্যালেন্ডারে ঝুলে থাকা উনিশে এপ্রিল, রাত বারোটা বাজলে ফ্লাইট ক্যানসেল হওয়ায় বাড়ি ফেরে মা, মেয়ের টেবিলে আবিষ্কার করে ঘুমের ওষুধের স্ট্রিপ, অসহায়তার অন্ধকারে জ্বলে ওঠে আশঙ্কার আলো। মুখোমুখি বসে মা-মেয়ে। ক্যালেন্ডারের পাতা বদলে দেয় অদিতি, বদলে যায় ঋতুপর্ণের পার্শ্বচরিত্রদের সম্পর্কের সমীকরণ, স্ক্রিনে থেকে যায় সময়ের দাগ- ক্যামেরার ফোকাসে থেকে যায় সেই ডেট ক্যালেন্ডার।
‘ইটস আ ওয়ান্ডারফুল লাইফ’ ছবিতে যেমন আলতার মতো মায়ার লাল ছাপ রেখে যায় জুজু’স পেটাল, ‘ফরেস্ট গাম্প’-এ যেমন মুহূর্তকে বন্দি করে একবাক্স চকোলেট, ‘দ্য পিয়ানো’ ছবির আত্মা যেমন বাঁধা কেবল পিয়ানোটিতে, বাংলা চলচ্চিত্রে তেমনই সোনার কাঠি-রুপোর কাঠি ঋতুপর্ণের প্রপেরা।
‘আবহমান’-এ ডিরেক্টরের চোখ রিলের রেলগাড়ি থেকে আচমকা খুঁজে পায় শিখার একটি ফ্রেম, ঠোঁটের কোণে জেগে ওঠে হাসি, যে শিখার সম্মুখ উপস্থিতি বিরক্তির কারণ ছিল অনিকেতের, ওই ফিল্মের স্ট্রিপে একটি ফ্রেম বদলে দেয় সবকিছু, শিখা থেকে শ্রীমতী হয়ে ওঠার পথ নির্মাণ করে ওই ফ্রেম, যে পথ দিয়ে গিরীশ ঘোষ-বিনোদিনীর বহুমাত্রিক সম্পর্ককে একুশ শতকের পর্দায় আনলেন ঋতুপর্ণ। ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ সিনেমায় অর্ণবের অপছন্দের অ্যাকোরিয়াম শেষ অবধি আমাদের সামনে নিয়ে আসে কাচের ভেতর বন্দি হয়ে থাকা ভাবনাদের। কাচের বাক্সে গণ্ডিঘেরা রঙিন মাছেদের মতো আমাদের সাবেকি খোলসে থাকা সামাজিক বেড়াকে অবলীলায় ডিঙিয়ে যান ঋতুপর্ণ, তাঁর রাজকীয় নির্মাণের ঘেরাটোপে কখনও দর্শক কেবলই মুগ্ধ হয়, পা দেয় তাঁর সাজানো চিত্রনাট্যের ঘেরাটোপে, কখনও বা স্বেচ্ছায় নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে তাঁর সম্মোহনের ছায়া থেকে। বাঙালির ঋতুপর্ণ তাই কেবলই চর্চিত বিষয়, ততটা আলোচিত নয়, চড়া মেকআপের স্তুতি কিংবা অযাচিত কৌতূহলই তাঁকে উপহার দিতে পেরেছে বাঙালি এত বছরে। তাঁর সিনেমায় মুহূর্ত বন্দি করার মুনশিয়ানা লুকিয়ে তাঁর চরিত্র নির্মাণে, অভিনেতার তূণীরে থাকা সংলাপ তিনি ভরেছেন নিজ হাতে, তাঁদের রাজবস্ত্রে কিংবা আভরণহীন সন্ন্যাসীবেশে সাজিয়েছেন তিনি নিজেই- এই সমস্ত চরিত্রদের নিয়ে আলোচনা হয়, অনালোচিত থেকে যায় বাড়ি-ক্যালেন্ডার-অ্যাকোয়ারিয়াম, যেন রাজার প্রাসাদের পাশে বসে আছে অভিমানী রাখাল, যার বাঁশিতে ধরা আছে চলচ্চিত্রের সরগমটি- ঋতুপর্ণ নিঃশব্দে এই চরিত্রদের সাজিয়েছেন, উপহার দিয়েছেন নৈঃশব্দ্যের সংলাপ। ব্যক্তিগত পরিসরে তিনি যতখানি একা, ততখানি একাকিত্বই যেন তিনি বুনে দিয়েছেন এইসব তথাকথিত ‘অমানবিক’ চরিত্রদের শরীরেও।…