কবীর সুমন। যাঁর গানে রাগ দুঃখ অভিমান কষ্ট টাটকাতাজা, জীবনজ্যান্ত। যে গান এক সশস্ত্র অভ্যুত্থান, সময়ের দাবি মেনে যে বারবার চক্রব্যূহে ঢুকবেই। সেই যুদ্ধে নাম হারায়, গোত্র হারায়, হারায় ধর্ম… অন্ধ জাতিস্মরের কী থাকে তা হলে? হয়তো গানটুকু, স্রেফ গানটুকু, এই মলিন আর এ-ধূসর পথ চাওয়া…
অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন লোকটার কথা, যিনি নিজেই একটা আস্ত গান। কবীর সুমনের ৭৫ উপলক্ষে সেই লেখা থাকল সংবাদ প্রতিদিন শোনো-য়।
পাঠ: শঙ্খ বিশ্বাস
ছবি: ব্রতীন কুণ্ডু
সুনামি আসার অনেক আগেই তো এসেছিলেন। সুমন। পরিণত জলোচ্ছ্বাসে, রাগী পদশব্দে। কাঁধে কাঠের গিটার, হৃদয়ে দোনলা বন্দুক ঝুলিয়ে। যেভাবে গুপ্ত আস্তানা থেকে উঠে আসতেন চে গুয়েভারা, যেভাবে গুহামুখ ফাটিয়ে বেরিয়ে পড়ে গলন্ত লাভা কিংবা কর্ক খুললে শ্যাম্পেনফোয়ারা- সেভাবেই সুমন এলেন। একেবারে ঢেউ তুলে দিলদরিয়ায়, সুনামি দাপটে। গোলাকার নীল আলোর বৃত্তে বাঙালি দেখল ধ্যাষ্টামোহীন, ভণিতাবাতিল, ভ্যানতারা-রহিত এক শিল্পীকে, যাঁর গানে রাগ দুঃখ অভিমান কষ্ট টাটকাতাজা, জীবনজ্যান্ত, যখনতখন খলবল করে উঠছে প্রতিভাটুকরো, অনর্গল আলাপচারিতা চালাচ্ছে মেধাবী মনন। শৌখিনতার গোলাপকুঞ্জে কোনও আতরগন্ধ ছিল না, গায়ে ছিল না কোনও গিলে করা কারুকাজ, আকাচা ডেনিমে সেদিন তিনি একা পাহারা দিয়েছিলেন মঞ্চ।
আমরা তখন ভিড় বাসের গায়ে ঝুলতে ঝুলতে পেরিয়ে যেতাম গড়ের মাঠ, সদ্য-শেখা নেশার গ্লাসে ছলকে ছলকে উঠত হাসি, টলতে টলতে আমাদের যৌবন তখন কোথায় যাবে তা নিয়ে কিঞ্চিৎ টাল খাচ্ছে- এমন সময়, সময়টাকে কামড়ে ধরলেন সুমন। ঠিক বাঘ যেভাবে শিকার ধরে।
প্রথম সুমনে ধরে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে। তখন সদ্য এসেছেন দেশে। সে বছরটা আশ্রয়বর্ষ। এক বন্ধুর অনুরোধে তিনি একটা গান বানিয়েছেন, বললেন। তারপর ধরলেন… ছুটবে কোথায় প্রেম তালকানা, গোপনীয়তার নেই মালিকানা, সেই প্রেমিকেরও আসল ঠিকানা দশ ফুট বাই দশ ফুট… আমাদেরও কেমন ঘোর লেগে গিয়েছে তালকানা প্রেমে, বুঁদ হয়ে ডুবে যাচ্ছি প্রথম আলাপের গর্ভে, জন্ম নিচ্ছেন আনকোরা এক পয়গম্বর… হঠাৎই দর্শকাসন থেকে কেউ একজন টিপ্পনী দিলেন। তিনি কী বলেছিলেন ঠিক মনে না-থাকলেও সুমনের প্রতিক্রিয়া মনে আছে এখনও। একগাল হাসলেন। মানে যেমনটা হাসলে, আসলে তিনি হাসেন না। আজও। ওটা বন্দুকে নিশানা লাগানোর ক্যামোফ্ল্যাজ। চিবুক-চাটা হাসি ধারালো হচ্ছে আস্তে আস্তে: অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে নিবেদন, আমার কিন্তু ডানহাতের কাজ হয়ে গিয়েছে বন্ধুরা। পয়সা পকেটে। বেচাল দেখলে স্টেজ থেকে নেমে আমি কিন্তু চলে যাব। ফাঁক পড়বেন আপনারাই। এই ঘোষণা শোনামাত্র সব চুপচাপ ফিসফাস। ফের শুরু হল গান, ভগবান কত ভালো, অপরের চোখ অন্ধ করেও আমাকে দিলেন আলো…।
যেন লোকটা নিজেই একটা আস্ত গান। তার আগে কই, ঠিক এমনটা তো শুনিনি। এই যে স্টেজে দাঁড়িয়ে যে- কথাগুলো বললেন, গানে কিংবা গানের বাইরে- সেগুলোও তো ভারি অদ্ভুত। পুরনো কোনও কিছু শোনার সঙ্গে মেলে না একবিন্দু। এই যে একগুঁয়ে, রাগী পদচারণা, অনমনীয়, আপসহীন ঔদ্ধত্য- এও বেশ মানায় লোকটাকে। কথা বলার মধ্যে কী একটা যেন আছে। মন্ত্র পড়লে বা খিস্তি করলে মনে হয় শুনতে দারুণ লাগবে
নব্বই-এর গোড়ার দিকটায়, বাংলাবাজারে বিশেষ কিছু ছিলও না। না কোনও রাজনৈতিক আন্দোলন, না কোনও সামাজিক মহাঘটনা, এমনকী মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের উত্তেজনাও তখন নাড়া দিত না মোটে। লোকে চুপটি করে তখন কালার টিভিতে ওয়ান ডে দেখত আর খুব কাশতে কাশতে আকাদেমি-তে নাটক। রাজনীতি বা যৌনতা দুই-ই ছিল এতটা ম্যাদামারা যে, ব্রিগেড কিংবা বিধুশ্রী আর মন টানত না বাঙালির। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট সরকার একদিন জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের ডিম পাড়বে, অতি বড় মুরগিও ভাবেনি কখনও। বিবর্ণ দেওয়ালে কিছু নিরামিষ প্রস্রাবের দাগ ছাড়া আর কিছুই লেগে ছিল না একটুও।
সেই মধ্যবিত্ততায় সুমন আসেন। মূর্তিমান কালভৈরব হয়ে। একটা গোটা প্রজন্মের স্বপ্ন, আশা, ইচ্ছেপূরণ হয়ে।
নতুন কিছু বাঙালিকে গেলানো চাড্ডিখানি কথা নয়। বিশেষ করে তারা যখন তেমন অভিনব কিছু শোনে, তখন, ‘আরে এটা তো আমাদের অমুকের তমুকটার মতো’ বলে নস্যাৎ করে দেয় বিলকুল। বাঙালি এমনিতে শিল্পরসিক জাত। শিল্পপুলিশও খুব। ফলে যে কোনও কিছুতেই, ‘হুঁ হুঁ বাবা কেমন ধরেছি’-র ধরতাই তাদের ঠোঁটের ডগায়। সুতরাং সুমন তো রেহাই পাবেন না সহজে, জানাই ছিল। কেউ-ই বলল, ভূপেন হাজারিকা-র মতো, কেউ বলল, এসব জীবনটিবন আইপিটিএ-তে কবে হয়ে গিয়েছে। বলল বটে, তবে তলে তলে খোঁজ রাখতে শুরু করল নতুন-আসা লোকটার।
দু’-একজন গোয়েন্দাস্বভাব বন্ধু খবর আনল, নকশাল ছিলেন তো, ওইজন্য পালিয়ে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। মানব মিত্র নাম নিয়ে লেখালেখি করতেন। তারপর আমেরিকাও খেপে যায়। দেয় বহিষ্কার করে। তখন লোকটা চলে যান নিকারাগুয়ায়। তারপর? তারপর? সেখানেই তো এত প্রতিবাদী বাংলা গান লিখে ফেলেন। আমাদের মনেও এমন সব বিশ্বাস দৃঢ় হয়। কেননা ভিয়েতনাম বা নিকারাগুয়া-দেশগুলো সম্পর্কে বিরাট ধ্যানধারণা না- থাকলেও, শব্দগুলো উচ্চারিত হলে, বেশ একটা গণ অভ্যুত্থানের খুশবু ভেসে আসে, মনে হয় ওসব দেশে সকলেই শহিদের চাকরি করে- সেই সুমহান যুদ্ধক্ষেত্রে জংলি ট্রেঞ্চে বসে সুমন লিখতেই পারেন এমন গান। এক ধরনের বিদ্রোহ যা।
এইসব ধন্দে-ধোঁয়াশায় দিন কাটলেও, আমরা দেরি করিনি মোটে। আমরা ছুটে ছুটে চলে যেতাম কলামন্দির কিংবা মহাজাতি সদনের অনুষ্ঠানে, অনুষ্ঠানের পর কৌতূহলী চোখ দেখে নিত, ঘর্মাক্ত মানুষটা চেয়ারে বসে সই দিচ্ছেন একমনে। সেদিনই হয়তো তাঁর গান শুনে আমাদের মনে পড়েছে, ট্রামে চেপে একা ঘুরে বেড়ানো সমর সেনের ফ্রন্টিয়ার, মনে পড়েছে ‘আরণ্যক’ বিভূতিভূষণ, কখনও অরুণ মিত্র উঠে দাঁড়িয়েছেন চকিতে। সেদিনই হয়তো ভরা কোটাল মরা কোটালের পর তিনি চুনী কোটালের নাম বলার আগে সুমনোচিত ভঙ্গিতে ‘বেজন্মার বাচ্চা’ বলে খেপে উঠেছেন, হয়তো কন্যা ভার্জিনিয়ার জন্য শিস দিয়ে গেয়ে উঠেছেন, তুই হেসে উঠলেই…।
মিডিয়া তখন সুমনের লেবেল নিয়ে বেশ চিন্তিত। এ কি প্রতিক্রিয়াশীল, না র্যাডিক্যাল অ্যানার্কিস্ট? বাম বুর্জোয়া না গেরিলা গানফাইটার? কোন মাপে আঁটবে? বোমা-টোমা আনেনি তো গিটারের ব্যাগে ভরে? এমন সশস্ত্র অভ্যুত্থান নকশাল আন্দোলনের পর সেই প্রথম দেখছে সাংবাদিককুল। অকারণ অহমিকা আর স্বভাবতাচ্ছিল্যে সুমনের গানের নাম দিল তারা- জীবনমুখী। কানা ছেলের নাম লোকে পদ্মলোচন দেয়, যা নয় তাকে হয় করতে, আর হায়, আমরা জেনেবুঝে নরসুন্দরকে মি. ইন্ডিয়া ডাকলাম না, নাপিত বানালাম।
তারপর অফিসে-ট্রামে-বাসে-উপনয়নে-অনশনে সবাই বলতে লাগল, হ্যাঁ হ্যাঁ সুমনের গান, হ্যাঁ ওই দাড়িওয়ালা লোকটা তো, স্টেজে খিস্তিখামারি করে, জানি জানি তোমাকে চাই, জীবনমুখী গায়। যেন জীবনমুখী কী, সবাই জেনে গিয়েছেন। যেন জীবন কোন তালে পা ঠুকছে, পুরোটা জানে সব ব্যাটাচ্ছেলে অমৃতলাল। যে জানলায়, এতদিন আগুন দেখেছেন সুমন, দেখেছেন তার মুখের আদল, সেই জানলায় এখন সারি সারি মরা মানুষ, দৃষ্টিহীন মানুষ, এক অবাকদৃশ্য দেখছে, তামাশা বা কৌতুকনকশা- অহো, এক জীবনমুখী গায়ক গান গাইছেন।
এক বিস্ময়-প্রতিভাকে সাধারণ দেখানোর ছাড়পত্র দিল পোড়ারমুখী গণমাধ্যম, যেন শুধুই জীবনমুখী, জীবনমুখী গায়ক সে। এক ব্র্যাকেটে নচিকেতা চক্রবর্তী, অঞ্জন দত্ত, শিলাজিৎ মজুমদারকেও রাখলাম। এবার জমবে মজা। সবাই জীবনমুখী। বহোত খুব। আমি আজ কানা-ই মাস্টার, পোড়ো মোর বেড়ালছানাটি।
কেউ কেউ বলল, একঘেয়ে। বড্ড ঘ্যানঘ্যানে সুর দেন লোকটা। সবই নাকি একরকম! আগেরটার মতো। আমাদেরই মতো। দু’টো করে হাত, দু’টো পা, চোখ নাক মুখ- মানুষেরই মতো একঘেয়ে। ল্যাজ কিংবা শিং নেই, ধুর। আমাদের শিল্পীর সুরের চলন যে তাঁরই সৃষ্ট পরিসরে স্বেচ্ছাবন্দি হতে পারে, সে-কথা ভাবল না কেউ। কেউ রুখে উঠে বলল না, তা হলে তো সব রবীন্দ্রসংগীত ভীষণ একঘেয়ে। সুরের ওঠাপড়া, চলনবলন খুব কাছাকাছি। বলেনি কেউ। কারণ রবীন্দ্রনাথ হলেন ঠাকুর। আর সুমন অমানুষ। কারণ তিনি অনেক বিবাহ করেছেন। বহু নারী-সংসর্গ। যদিও সুরের সঙ্গে, কথার সঙ্গে এই সম্পর্কগুলোর কোনও সংঘাত নেই আপাতভাবে, কিন্তু নিস্তরঙ্গ মধ্যবিত্ত জীবনে, বহুবিবাহের অভিঘাত সর্বনাশা। যদিও কেউ কেউ মৃদু আপত্তি তুলে জানান দিল, যদি বা মানুষটা একাধিক বিবাহ, সম্পর্ক করেই থাকেন, সেগুলো কিন্তু একে একে করেছেন, একইসঙ্গে অনেকে লিপ্ত হয়েছেন, ভালোবেসেছেন, এমনটা হয়তো নয়। কিন্তু আমাদের শিল্পীকুলের চরিত্র হল সবার আগে। সেখানেই শরবিদ্ধ সুমন। গান যেমনই বানান, কমলালেবু কি তিনি বিতরণ করেছেন শনিবার শনিবার নির্মল হৃদয়ে?
ফলে লোকটা গান না হারালেও, মান হারালেন। লাগাতার অপ্রশংসা আর পাবলিক ঔদাসীন্যের মানচিত্রে, হয়তো বা পথও হারালেন খানিক। দেখা গেল, অনুষ্ঠান করিয়ের দল মুখ ফিরিয়েছে সুমনের গানের হল-বুকিং থেকে। ততদিনে অবশ্য বাছাই করা অ্যালবামরা ছড়িয়ে পড়েছে সুমনের গুপ্তচর সেজে। বেপরোয়া শিল্পীকে মঞ্চে পাওয়ার থেকে অডিও ক্যাসেটে আর নীল সোফাসেটে বসে মিঠে খুনসুটি সমেত পাওয়ার আগ্রহ শ্রোতাদের বেশি, জীবনমুখীর যৌবনও তখন প্রচারে প্রচারে অস্তমিত। এই ঠান্ডা মেরে যাওয়া, থিতিয়ে যাওয়া দশা, সব শিল্পীকে কখনও-না-কখনও সইতে হয়। সুমনকেও হয়েছে। বাঙালি শ্রোতা তাঁকে যতটুকু গ্রহণ করতে পেরেছে, ততটুকুই হয়তো তাদের জন্য মাপা ছিল, পাঁচতারা বুফে-তে কোনওদিনই কি অত কিছু একসঙ্গে খাওয়া গেছে কোনওকালে!
একটু একটু করে স্মৃতিতে চলে যাওয়া সুমন ফের শিরোনামে এলেন ধর্মান্তরিত হয়ে। তখন মুখরোচক এক বিতর্ক সমস্ত ককটেল পার্টিতে- কেন তিনি কবীর সুমন হলেন? নতুন গিমিক? সাবিনা ইয়াসমিনের জন্য? একজন মানুষের নিজস্ব গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে মুখর হল দুনিয়ার লোক, যারা তাঁর নমাজ বা গায়ত্রী মন্ত্র পড়ে দেবে না কখনও, নিদেনপক্ষে গানও বেঁধে দেবে না!
এমন নয়, আমার সুমনের ব্রাহ্মণ্যবাদে বিশেষ আস্থা ছিল। আবার সুমনের কবীরত্ব নিয়েও ভেবে উঠিনি কখনও, কারণ শিল্পীর আবার ধর্ম কী? সুমনের মতো আশ্চর্য শিল্পীর? গান বাঁধা ছাড়া? যিনি লেখেন, ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু!
আরও আরও দূরে চলে গেলেন লোকটা। এখন নিজের সুড়ঙ্গে সে নিজেই গান বানায়, গান শেখায়। তাঁকে ঘিরে থাকেন উৎসাহী একপাল বন্ধুমানুষ, একজন শিল্পীকে ভালবেসে শেষমেশ যাঁরা ভাগশেষ রয়ে যান। শত গোঁয়ার্তুমিতেও সুমনকে ত্যাগ দেননি যাঁরা। সুমন তখন চ্যানেলে চ্যানেলে টক শো করছেন, স্বভাববিনয়ে কথা বলছেন টেলিফোন-কলার’দের সঙ্গে এবং তাদের ত্যাঁদড়ামোতে এতটুকু রাগছেন না। নতুন গান কি করছেন না! করছেন। তবে তা ততখানি নতুন হয়ে বুকে বাসা বাঁধছে না হয়তো। তেমন গা শিরশির করছে না, যেমনটা আগে হত। বয়সের ত্রিকোণমিতি একটু একটু করে হয়তো বা থাবা বসাচ্ছে ভিনটেজ কণ্ঠস্বরেও।
তবুও তিনি নাছোড় এক পারফর্মার। তবুও তিনি পয়সা ফেলে শেখাতে পারেন ভানুমতীর খেল। বব ডিলান তাঁরই জন্য অনুষ্টুপ ছন্দে ব্যালাড বাঁধেন। পিট সিগার তাঁর বন্ধুর জন্য গিটার পাঠিয়ে দেন।
সে-হেন সুমনকে আজ নতুন করে চিনছে পশ্চিমবঙ্গ, সারা দেশ। তিলে তিলে জমা হওয়া একটা নন্দীগ্রাম সুমনকে পতাকা দিচ্ছে। প্রতিটি অনুষ্ঠান, প্রতিটি সমাবেশে ফেটে পড়ছেন তিনি। আবার সুমনকে কেন্দ্র করে জড়ো হচ্ছে সুমনমুখী এক আন্দোলন। এ এক বিক্ষুব্ধ, ক্ষতবিক্ষত মানুষ, চোখের বদলে চোখ উপড়ে ফেলতে যাঁর হাত কাঁপবে না।
একই জীবনের মধ্যে একজন মানুষ কতবার জন্মান? কতবার মারা যান? কতবার হারিয়ে যান? কতবারই বা ভেসে ভেসে ওঠেন? নাম হারিয়ে যায়, গোত্র হারিয়ে যায়, ধর্মও- কী থাকে, অন্ধ জাতিস্মরের কী থাকে তা হলে? হয়তো গানটুকু, স্রেফ গানটুকু, এই মলিন আর এ-ধূসর পথ চাওয়া… এ চাওয়ার রং নাও তুমি…
যে-সুমনকে সবটা চিনতাম আমি, সে-সুমনের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল না। সাহসও ছিল না সামনে যাওয়ার। আর যে-সুমনের সঙ্গে আলাপ হল, তাকে আবার আমি চিনি না পুরোটা। এই সুমন ভোটে দাঁড়ান লোকসভা নির্বাচনে, দেওয়াল লেখেন লোকাল বাচ্চা কোলে। সুমনের জন্য ভয় লাগে কিন্তু অবাক লাগে না। এ মানুষ এমন টেরাব্যাঁকা বাঁশের সাঁকো দিয়েই পার হবেন বরাবর, বুঝে গিয়েছি। ভোটে হারা-জেতায় কি কিছু আসে যায়? আমার কাছে জিতে গেলেও তিনি সন্ত তো হবেন না। আর যদি হেরে যান? হেরে গেলেও তিনি সুমন। তিনি মানুষেরই মতো পূর্ণ, মানুষেরই মতো নিঃস্ব। এই জায়গাটায় অনেকের জমানত বাজেয়াপ্ত করে তিনি জিতে রয়েছেন বহুকাল।
শেষ জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গান গাইছেন সুমন। কী আশ্চর্য, কথা বলছেন না গানের মাঝে। শুধু গাইছেন। কত সব পুরনো গান, যেগুলো বহুদিন গান না। ভালোবাসার গান গাইছেন ভালোবেসে। যেন অন্য এক মানুষ। কখনও অলোকরঞ্জনের পায়ের কাছে বাবু হয়ে বসে, কখনও ঊর্মিমালা বসুর সঙ্গে রসিকতায় চঞ্চল, কখনও সাবিনা ইয়াসমিনের দিকে চেয়ে, এক মুহূর্তে ফিরিয়ে দিলে…। দৃশ্যত কিছুই বলছেন না। আবার না-বলেও যেন অনেক কিছু বলছেন। এক-একটা গান যেন ধারাবিবরণী দিয়ে উঠছে আমাদের যৌবনের, বুকের ভেতর ঢেউ ডাকছে ছলাৎছল, খুরের শব্দ কাছে আসছে ফের।
কলামন্দির ভরিয়ে দিয়েছেন যে-দর্শকদল, সুমন তাঁদের নামে চেনেন। সুমন জানেন, তাঁর গান কারা শোনেন, কেমন শোনেন, কোথায় শোনেন। সুমন জানেন, এঁরাই তাঁর অবশিষ্ট আত্মীয়, ভাঙাগড়ার সংসার- যাঁরা লখনউ ছেড়ে চলে যাননি আজও।
তাঁদেরই সামনে সুমন বলছেন, এক-একটা সময় দাবি নিয়ে আসে। সময়ের দাবি। সব কিছু ওলটপালট হয়ে যায় তখন। সুমন বলছেন, আমি সেই অভিমন্যু, যে-চক্রব্যূহে প্রবেশ করতে চাই বারবার। সুমন গাইছেন, ছোটবেলায় শেখা মীরার ভজন। সুমন গাইছেন, ডেকো না আমারে ডেকো না ডেকো না… ডেকো না… যেন ছেলেবেলার সেই বেহালা বাজানো লোকটা চলে গেল বেহালা নিয়ে… চলে গেল গান শুনিয়ে…
অনেক দূরে কোথাও ঘণ্টা বেজে ওঠে। জনতার হাতে হাতে বিলি হয় মনখারাপের ডাকটিকিট। গঙ্গার ধারে ঝিম মেরে যায় মেঘলা বিকেল। কলেজ ছুটি হয়ে যাওয়ার পরও আমরা বসে থাকি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। রাস্তা পার হয়ে যায় অন্ধ ভিখিরি। তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে আসে বাবা। গড়ের মাঠ থেকে ভেসে আসে কুচকাওয়াজের শব্দ। অনেকদিন পর মেয়েটি হ্যাঁ বলে ছেলেটিকে। ফুটপাতে জোছনা লাগে…
দূরে কোথাও দু-এক পশলা সুমন হচ্ছে।