বাংলাদেশ নয়, তাই বাংলায় কথা বলা যাবে না। খাস কলকাতার বুকে মেট্রো রেলে ফতোয়া শুনলেন বাঙালি মহিলা। সদ্য অতীতেই যে বাংলা ভাষা ধ্রুপদী স্বীকৃতি পেয়েছে, এহেন ফরমান জুটল তারই কপালে। ধ্রুপদী হল বাংলা, তবে পদমর্যাদা বাড়ল কি?
বাংলা এখন ধ্রুপদী। তবে, পদে উঠল কি? নাকি, পদমর্যাদার বেলায় তার ভাঁড়ার একইরকম ফাঁকা? সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে তেমন সন্দেহ না করে উপায় কী! না হলে খোদ বঙ্গভূমের রাজধানীতে, কল্লোলিনী কলকাতার মেট্রোবাহনে এহেন ফতোয়া শুনতে হয়- এটা বাংলাদেশ নয়, অতএব বাংলা বলা মানা, বলতে হবে হিন্দি!
অবশ্য বঙ্গভূমে বাংলা এখন আর কতটুকুই বা শোনা যায়! বাংলাটা ঠিক আসে না- এ তো সেই কবে থেকেই বাঙালির মুখের বুলিতে ঘুরছে ফিরছে। বাংলা মিডিয়াম স্কুল ধুঁকছে তো বটেই, স্কুলে বাংলা শিখলেও নাকি শিক্ষায় থেকে যাবে ভুল- এ কালের মা-বাবারা স্থিরনিশ্চিত। দিনভর ফোনে অজস্র বিজ্ঞাপনী কল আসে, ওপারের সেলসবালক বা বালিকারা কথা শুরুই করেন হিন্দি ভাষায়। পশ্চিমবঙ্গে বসে, নিপাট বাংলা নামের মধ্যবিত্ত হিন্দি শুনলেই ক্রেডিট কার্ড নিতে রাজি হয়ে যাবে- এমন ভাবনার কারণ কী কে-ই বা জানে! শপিং মল থেকে রেস্তরাঁ থেকে বিমানবন্দর- ছবিটা সর্বত্রই এক। উত্তরপ্রদেশে গড়গড়িয়ে হিন্দি, দক্ষিণ ভারতে হুড়মুড়িয়ে তেলুগু-মলয়ালম বলে পরিষেবা নিয়ে চলে যাচ্ছেন বাসিন্দারা, অথচ আপনি বাংলায় দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষায় জিনিস কিনতে চান- ঝাঁ চকচকে কাউন্টারের সুবেশ বিক্রেতা সন্দেহের চোখে আপনার পকেট দেখে নেবেন পারলে!
আসলে এইটাই তো আসল কথা। যে মাতৃভাষার সঙ্গে পুঁজির যোগ কম, আজকের দুনিয়া তাকে ক্রমশ বাতিলের খাতায় ঠেলতে চায়। বাংলা ভাষা তো পৃথিবীর সেই বিরল ভাষাগুলির মধ্যে অন্যতম, যে ভাষার জন্য শহিদ হতেও দ্বিধা করেননি অনেক মানুষ। কিন্তু আজকের দিনে পুঁজির বাজারের সঙ্গে তার যোগ কতটুকু! খোদ বাংলার বুকেও চাকরির বিজ্ঞাপনে বাংলা মিডিয়ামকে নাকচ করা হচ্ছে, অথবা চাওয়া হচ্ছে হিন্দি ভাষায় দক্ষতা। বাঙালিকে ভিনরাজ্যে বাস করতে হলে সেখানকার ভাষা শিখে নিতে হয়, কিন্তু ভিনরাজ্যের মানুষেরা এ রাজ্যে দিনের পর দিন থেকেও, রুটিরুজি উপার্জন করেও বাংলা শেখার প্রয়োজন দেখেন না। কেন-না বাংলা তাদের ভালবেসেই আপন করে নিয়েছিল, তাদের উপর কোনও কিছু চাপিয়ে দিতে চায়নি। যদিও সেই উদারতা এখন বাঙালিকেই কোণঠাসা করে দিচ্ছে কি না- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। বাংলায় দাঁড়িয়ে বাঙালির বাংলা বলার বিরুদ্ধে নিদান এলে তেমন আশঙ্কা হয় বইকি।
যদিও সাম্প্রতিক অতীতে বাংলা ধ্রুপদী ভাষার তকমা পাওয়ার পর মনে করা গিয়েছিল, এতদিনের অসম্মানের ধুলো সামান্য মুছে গেল বুঝি। বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা, ভালোবাসার ভাষা, কিন্তু সে কাজের ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি বলেই পুঁজির দৌড়ে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে, এমন অভিযোগ বারেবারেই শোনা গিয়েছে। সেই আক্ষেপ-অভিযোগের মিছিলে কিছুটা হলেও বাঁধ দেবে এই কেন্দ্রীয় স্বীকৃতি, এ আশা করেছিলেন অনেকেই। কেন-না, এই স্বীকৃতির দরুন কেন্দ্রীয় উদ্যোগেই বাংলা ভাষা চর্চাকে ভিত্তি করে একাধিক কাজের পরিসর খোলার কথা। পাশাপাশি, বিশ্বায়নের দুনিয়ায় বাংলা ভাষা দীর্ঘদিন ধরে যে বিপুল অবহেলা কুড়িয়ে এসেছে, যে ভাষিক হীনম্মন্যতা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে, তার উলটোদিকে দাঁড়িয়ে এই গৌরব বাংলা ভাষাকে সম্মানের কথা বলবে- এমন আশা ছিলই। তবে দেখা যাচ্ছে, রিল দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী স্মৃতিতে সেসব কথা বেঁচে থাকা মুশকিল। সম্প্রতিই জানা গিয়েছে, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক রবীন্দ্র চেয়ারটি যে ছিল এককালে, সে কথাই ভুলে গিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এবার কলকাতার বুকেও বাংলা ভাষা নিয়ে বিতর্ক প্রশ্ন তুলে দিল- ধ্রুপদী মর্যাদা মিলল বটে, তবে বাংলা ভাষার মর্যাদা ফিরল কি?
ছবি: দীপঙ্কর ভৌমিক