আকস্মিকের খেলা। রেডিও-তে তাঁর যাত্রা শুরুকে হয়তো ব্যাখ্যা করা যায় এভাবেই। আচমকাই চোখে পড়া বিজ্ঞাপন, আবেদন জমা দেওয়া, আর কাজ শুরু। সেই থেকে টানা ২৭ বছর বাংলা রেডিওর বহু বিবর্তনের সাক্ষী তাঁর কণ্ঠ। তাঁরই জন্মদিন তাই মিশে যায় বিশ্ব রেডিও দিবসে। তিনি বলেন এ ঘটনা কাকতালীয়। তাঁর গুণমুগ্ধরা বলেন, এমনটা হওয়াই তো স্বাভাবিক। পুরনো দিনের গল্প থেকে আগামী দিনের স্বপ্ন- জন্মদিনে ফোনের ওপারে খোলামেলা আড্ডায় মীর।
তাঁর কণ্ঠস্বরেই ঘুম ভাঙে শহরের। রেডিওর ওপার থেকে তিনি শোনাতে থাকেন সকালের রোজনামচা। আর আড়মোড়া ভেঙে শহরবাসী খুঁজে নেয় তাঁর সারাদিনের রসদ। তিনি মীর। ১৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্মদিন। এই দিনটাকেই পালন করা হয় ‘ওয়ার্ল্ড রেডিও ডে’ হিসাবে। যেন তাঁর জন্যই তুলে রাখা ছিল এই দিনটা। তিনি নিজেও যখন প্রথম তা খেয়াল করলেন, তখন আশ্চর্যই হয়েছিলেন। কেমন ছিল সেদিনের অনুভূতি? তিনি বলছেন, “সেটা ২০১০ সালের কথা। আমি একটা শো করতে যাচ্ছিলাম। যাওয়ার পথেই মোবাইলে নোটিফিকেশন দেখে গুগল সার্চ করতে গিয়ে বেরোয় যে, ইউনেস্কো এই দিনটাকে ওয়ার্ল্ড রেডিও ডে হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উদযাপন শুরু হবে পরের বছর অর্থাৎ ২০১১ থেকে। এই খবরটা দেখে এত আনন্দ হয়েছিল যে, মনে হয়েছিল জন্মদিনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহারটা ইউনেস্কোর থেকেই পাওয়া। শুধু আমার কথা বলছি না, বা রেডিওতে যিনি কণ্ঠদান করছেন তিনিই শুধু নন, রেডিওর সঙ্গে জড়িত যে কারও যদি আজ জন্মদিন হয়, তবে নিজেকে তিনি স্পেশাল মনে করবেন। খুবই কাকতালীয় ঘটনা। এটার থেকে বড় উপহার বোধহয় আর কিছু হতে পারে না।”
আরও শুনুন – বাংলা মানে শুধু মিষ্টি দই-রসগোল্লা নয়, বাংলাকে চেনা যায় আত্মসম্মানের গরিমাতেই
রেডিওয় তাঁর যাত্রা শুরুর ঘটনাটাও কম কাকতালীয় নয়। সেদিনের কথা মনে করে আজও বিস্মিত হন মীর। স্মৃতিতে ডুব দিয়ে মীর বললেন, “সেটা ছিল ১৯৯৪ সাল, ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি আসছে। পাড়ার ধোপার দোকানে গিয়েছিলাম জামাকাপড় আনতে। মা বলেছিল, একটা রিকশা করে নিস, নইলে কাচা জামাকাপড় আবার ভিজে যাবে। তো ওই পাড়ার দোকানে যেভাবে খবরের কাগজে মুড়ে সুতো দিয়ে বেঁধে দেয়, সেভাবেই কাপড়গুলো দিয়েছে। আমি নিয়ে একটা হাতে-টানা রিকশায় উঠেছি। আমার একটা অভ্যাস ছিল যে, খবরের কাগজ যেখানে যা পেতাম, পড়ে ফেলতাম। মানে, হয়তো সিঙাড়া খেয়েছি, সেই ঠোঙাটাও পড়ে ফেললাম। ওই অভ্যাসটা না থাকলে হয়তো পরবর্তী ঘটনাগুলো ঘটত না। রিকশায় বসে দেখলাম, কাপড়গুলো যে কাগজে মুড়ে দেওয়া হয়েছে, সেখানে একটা বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে। একটা বেতার সংস্থার তরফে দেওয়া বিজ্ঞাপন, রেডিও জকি খুঁজছে সংস্থাটি। তারিখটা খেয়াল করে দেখলাম যে, আবেদনের ছটা দিন পেরিয়ে গেছে। হাতে আর একটা দিনই আছে। ছোটবেলা থেকেই রেডিও বলতে আমি পাগল, কাজ করার খুব ইচ্ছে, কিন্তু সেদিন মনে হল, একটা সুযোগ পেয়েও বুঝি হারালাম। এতদিন কি আর লোক নেওয়া বাকি আছে! তাও এক বন্ধুর উৎসাহে, তারই টেপরেকর্ডারে আমার কণ্ঠস্বর রেকর্ড করে পরদিন গিয়ে দপ্তরে জমা দিয়ে আসি। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে কিছুই হবে না। সেদিন কমপিউটর ট্রেনিং-এর ক্লাস ছিল, করতে গেছি, ফিরে এসে শুনলাম যে ল্যান্ডলাইনে ফোন এসেছিল। মা বলল, সেদিনই দেখা করতে বলেছে। আমি তো গোড়ায় ভেবেছিলাম, রসিকতা করেছে কেউ। যাই হোক সেদিনই গিয়ে দেখা করেছিলাম। আমাকে বলা হয়েছিল, পরের দিন একটা ইন্টারভিউ দিতে। সেই শুরু। তারপর বাকি যা ঘটছে এই ২৭ বছর ধরে, সে তো চলছেই। আজও আমার ভেবে খুব আশ্চর্য লাগে যে, যেদিন আমি আবেদনপত্র জমা দিয়েছিলাম সেদিনই ডাক এসেছিল রেডিও থেকে। আর ২০১১ সাল থেকে যখন ওয়ার্ল্ড রেডিও ডে ঘোষণা করা হল, তখনও একইরকম আশ্চর্য হলাম। মনে হয়েছিল, সবকিছুই যেন বেশ চমৎকার একটা ষড়যন্ত্র, কেউ আমার জন্যই করে রেখেছেন।”
আরও শুনুন – ‘লাঞ্ছনা’ সত্ত্বেও সুভাষকে ভোলেননি ইংরেজ অধ্যাপক ওটেন সাহেব, লিখেছিলেন কবিতাও
রেডিও মানেই শ্রোতার কাছে এক অপার বিস্ময়। যন্ত্রের ভিতর মনে হয় মানুষ বসত করে। আর সেখান থেকেই প্রতিদিন নিয়ম করে কথা বলে ওঠেন তাঁরা। আবার সেই বিস্ময়ের ঘোর কেটেও যায়, যখন কণ্ঠস্বরের মালিককে চাক্ষুষ করা যায়। সেরকম অভিজ্ঞতাও হয়েছে মীরের জীবনে। সে-গল্প শুনিয়ে তিনি বললেন, “রেডিওকে নিয়ে বিস্ময় তো আমার নিজেরই ছিল। পরবর্তীতে যখন কাজ করতে এলাম, তখন এরকম ঘটনার সাক্ষী হয়েছি। আমার একজন শ্রোতা, আমাকে তাঁর ছেলের মতো মনে করতেন। মানে, আমার কণ্ঠস্বরে তাঁর পুত্রের স্পর্শ পেতেন। রেডিও সূত্রেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। চিঠি আদানপ্রদান হত। পরে তিনি যখন আমাকে টেলিভিশনে দেখলেন, তখন ওই মিস্টিক অরাটা আর থাকল না। তিনি আর আমাকে তাঁর ছেলে মনে করতে পারছিলেন না। সেটাও তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন। কষ্ট পেয়েছিলেন। এই ঘটনাটা আজও আমাকে নাড়া দেয়। বিশেষত এরকম দিনগুলোয় ভেবে একটু কষ্টই পাই।”
হাজারও বিনোদনের মাধ্যম এখন আমাদের চারপাশে। তার ভিতর রেডিও কি সামান্য পিছনে সরে গিয়েছে? আজও যাঁরা রেডিও নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, রেডিওতে কাজের স্বপ্ন দেখেন, তাঁদের জন্য মীর বলছেন, “একটাই কথা বলার, যে রেডিও মাধ্যমটা কিন্তু প্রায় ১০০ বছর ধরে চলছে। আমরা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করব যে, এরকম একটা মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত আছি। গণমাধ্যমের বদল হবে, অনেক নতুন নতুন মাধ্যম আসবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার মধ্যেই যিনি এই মাধ্যমটায় বিশ্বাস করেন, তিনি যদি ডেডিকেশনের সঙ্গে তাঁর কাজটা করেন, তাহলেই সবকিছু ঠিক হবে। চেঞ্জ আসবেই। মনে রাখতে হবে, সবকিছুরই সহাবস্থান আছে। রেডিও, টেলিভিশন, অন্যান্য মাধ্যম- সব নিজের মতো করে পাশাপাশিই থাকবে। তার মধ্যে থেকেই লড়াইটা করতে হবে, আর সেটা সকলে মিলেই করতে হবে।”
আরও শুনুন – পোলাও কই? প্রশ্ন ছোট্ট নবনীতার, খুদে অতিথির মানরক্ষায় উদ্যোগী স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ
রেডিও আসলে এক স্বপ্নের নাম। অদেখা এক মায়াবী পৃথিবী তৈরি হয় সেখানেই। না, যন্ত্র নয়, সে পৃথিবী আমাদের উপহার দেন কোনও কোনও মানুষই। এ-ও এক শিল্প। এ-শিল্পের সাধক যিনি তাঁর জন্মদিন যে রেডিও দিবস হয়ে উঠবে, সে বুঝি আশ্চর্যের নয়, বরং স্বাভাবিকই। তাঁকে জানাই শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন মীর। আপনার কণ্ঠস্বরে আরও বহুদিন ঘুম ভাঙুক আমাদের, জেগে থাকুক রেডিও-উপস্থাপনার শিল্পময় জগৎ।