দুর্গাপুজোর পর কালীপুজো পেরিয়ে সিংহবাহিনী দেবী জগদ্ধাত্রীকে আবাহন করে বাঙালি। বস্তুত এক বাঙালির হাত ধরেই শুরু হয়েছিল জগদ্ধাত্রী দেবীর পুজো। কীভাবে শুরু হয়েছিল এই পুজো?
পণ্ডিতদের মতে, দেবী জগদ্ধাত্রী আসলে দেবী চণ্ডীরই এক রূপ। বাংলার পাল-সেন যুগের বিভিন্ন তন্ত্র গ্রন্থেও সিংহবাহিনী জগদ্ধাত্রী পুজোর উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘মায়াতন্ত্র’ মতে, কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দিনের শুরুতে মধ্যাহ্নে এবং সায়াহ্নে জগদ্ধাত্রী পুজো করা যায়। অষ্টাদশ শতকের বাংলায় এই পুজোকেই প্রায় দুর্গাপুজোর বিকল্প করে তুললেন নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র।
আরও শুনুন: কেরানি থেকে হলেন সাধক কবি, মা কালী কি সত্যিই কৃপা করেছিলেন রামপ্রসাদ সেনকে?
কেন এমন করেছিলেন তিনি? প্রচলিত কাহিনি জানায়, বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব তখন আলিবর্দি খাঁ। নবাবের খাজনা মেটাতে না পারায় কারাগারে বন্দি হয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। সালটা ১৭৫৪। শোনা যায়, সময়টা ছিল দুর্গোৎসবের কাছাকাছি। মুক্তি পেয়ে যেদিন নৌকায় ফিরছেন কৃষ্ণনগরে, সেদিন বিজয়া দশমী। নিজে দুর্গাপুজো করতে পারলেন না, এই কষ্টে কাতর হয়ে পড়েছিলেন রাজা। আর সেই সময়েই নাকি তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন দেবী তাঁকে বলছেন আগামী কার্তিক মাসের শুক্লানবমী তিথিতে তাঁর পুজো করতে। কিন্তু দেবী রক্তবর্ণা, চতুর্ভুজা, সিংহবাহিনী। দেবীর কথামতো সেই রূপেই তাঁর আরাধনা শুরু করলেন ‘বাংলার বিক্রমাদিত্য’ কৃষ্ণচন্দ্র।
এই প্রসঙ্গেই শোনা যায় একটি ভিন্ন মতও। ১৭৬৪ সালে কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর পুত্র শিবচন্দ্রকে মুঙ্গেরের কারাগারে বন্দি করেছিলেন তৎকালীন নবাব মিরকাশিম। ইংরেজদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার সন্দেহে তাঁর প্রাণদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন নবাব। বন্দিদশায় কৃষ্ণচন্দ্র এক কুমারী দেবীকে স্বপ্নে দেখেন। দেবী তাঁকে মুক্তিলাভের প্রতিশ্রুতি দেন। জনশ্রুতি, কিছু দিনের মধ্যেই তিনি সত্যি কারামুক্ত হয়েছিলেন। এর পরেই মেরতলার প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রের সহায়তায় দেবীর পূজার আয়োজন করেন কৃষ্ণচন্দ্র। তবে রাজপরিবারের বৈষ্ণবাচার্য কুলগুরু এই নতুন শাক্ত দেবীর পুজোয় অনুমতি দেবেন কি না সে সংশয় ছিল। তাই রাজবাড়িতে পুজোর জোগাড় করার ভার পড়েছিল শিবচন্দ্র ও গোপালভাঁড়ের উপর। চন্দননগরে বন্ধু ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর গৃহে কদিন কাটিয়ে পুজোর আগের দিন গভীর রাতে গোপনে কৃষ্ণনগরের প্রাসাদে ফিরে এসেছিলেন মহারাজা। উপবাসী থেকে পরের দিন সকালে অঞ্জলি দিয়েছিলেন। যাতে কুলগুরুর তরফ থেকে কোনও বাধা না পোহাতে হয়।
আরও শুনুন: রবি ঠাকুরের গানে উঠে এল দেবী লক্ষ্মীর কথা, জানেন কী সেই গান?
স্বপ্নাদেশে কুমারী রূপিণী দেবীর দেখা পেয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র, তাই রাজবাড়ির প্রতিমার মূর্তি এখনও কুমারী বালিকার মতো। সকালে সাত্ত্বিক, দুপুরে রাজসিক আর সন্ধ্যায় তামসিক রূপে তিনবার পুজো করা হয়। গবেষকদের মতে, বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তন করেন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই। আর আজ যে চন্দননগর জগদ্ধাত্রী পুজো উপলক্ষে আলোর খেলায় সেজে ওঠে, সেই পুজো শুরুর পিছনেও পরোক্ষ কারণ তিনিই। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পুজো দেখে মুগ্ধ হয়ে পরের বছর চন্দননগরে এই পুজো শুরু করেন মহারাজের বন্ধু ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। সেখান থেকে ক্রমে ক্রমে শুরু হয় সর্বজনীন জগদ্ধাত্রী পূজা।