পরীক্ষা হোক কি ইন্টারভিউ, শুভ কাজে যাওয়ার আগে কপালে দইয়ের ফোঁটা না লাগালে, কিংবা এক ফোঁটা দই মুখে না তুললে চলবেই না। তাতেই নাকি মিলবে ভাল ফল। এমন বিশ্বাস রয়েছে আমাদের অনেকের মধ্যেই। অথচ বাঙালি যাকে এমন সব কাজের কাজি করে তুলেছে, সেই দই কি আদতে বাঙালি? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
কোনও মঙ্গল অনুষ্ঠানের শুরুয়াত থেকে শেষপাত, দই সবেতেই সগৌরবে হাজির। বিয়েবাড়ি হলে তো কথাই নেই। শুরু হয় দধিমঙ্গল দিয়ে, আর ভোজের উপসংহার টানে মিষ্টি দই। বাঙালির যে কোনও শুভ কাজে দই কিন্তু অপরিহার্য। মঙ্গল উপাচারের কথা ছেড়েই দিন, দইয়ের স্বাদে মজেননি এমন বাঙালিও তো বিরল। যাঁরা স্বাস্থ্যসচেতন, টক দই তাঁদের ডায়েট চার্টে জাঁকিয়ে বসে আছে। আর মিষ্টি দই বানানোর কৃতিত্ব তো একচেটিয়া ভাবে দাবি করেই আসছে বাঙালি। কিন্তু, এত হইচই যাকে নিয়ে, সেই খাবারটির উৎস কি আদৌ বাংলা?
আজ্ঞে না। দইয়ের বাঙালিত্ব নিয়ে যতই গলা ফাটানো হোক, দই মোটেই এখানকার খাদ্য নয়। এমনকি বাংলা তো দূর, ভারতের কোনও প্রদেশেই দইয়ের উৎপত্তি হয়নি। তাহলে? খাবারের ইতিহাসে বেশ প্রাচীন এই বস্তুটির উৎস কোথায়?
আরও শুনুন: ম্যাজিক মিষ্টি হাওয়াই মিঠাই, ছোটদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন জনৈক দন্তচিকিৎসকই
দুধ এবং ব্যাকটেরিয়ার যুগলবন্দিতে তৈরি এই খাবার। আর যে ব্যাকটেরিয়া দুধকে দই বানিয়ে ফেলার জন্য দায়ী, তার নাম ল্যাক্টোব্যাসিলাস বুলগেরিকুশ। এবার আন্দাজ করতে পারছেন কি? হ্যাঁ, বুলগেরিয়া-ই। এই দেশটির সূত্রেই বাকি দুনিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে দইয়ের পরিচয় ঘটেছিল। দই এবং লস্যি এই দেশের জাতীয় প্রতীকও বটে। সরকারি উদ্যোগে বড় আকারে ডেয়ারি শিল্প স্থাপন করা ছাড়াও পৃথিবীতে একমাত্র দইয়ের মিউজিয়াম আছে এই দেশেই।
প্রায় চার হাজার বছর আগে যাযাবর জাতির মানুষদের হাত ধরেই সে দেশে এই খাবারটির চল হয়েছিল বলে মনে করা হয়। প্রাণীর চামড়া দিয়ে বানানো থলিতে দুধ রাখা হত, আর সেই দুধ পরিণত হত দইয়ে। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, যাযাবরদের সূত্রেই আরও কিছু কিছু অঞ্চলে এই খাবারটি ছড়িয়ে পড়ে। আধুনিক যুগে অবশ্য মানুষ কেবল দই খেয়েই খুশি রইল না, এই খাবার কীভাবে তৈরি হয়ে উঠছে তা নিয়েও গবেষণা জুড়ে দিল। অবশেষে বিশ শতকের গোড়ায় বুলগেরিয়ান বিজ্ঞানী স্ট্যামেন গ্রিগোরভ চিহ্নিত করলেন দই তৈরির জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়াটিকে। মজার কথা হল, তিনি গবেষণা করতেন সুইজারল্যান্ডের জেনিভা শহরে। আর গবেষণার জন্য তাঁকে দই নিয়ে আসতে হয়েছিল নিজের দেশ বুলগেরিয়া থেকেই। বুলগেরিয়াকে সম্মান জানাতেই দেশের নাম অনুসারে নামকরণ করা হয়েছে ওই ব্যাকটেরিয়ার।
আরও শুনুন: চেটেপুটে মালাইকারি কে না খান! সুস্বাদু এই পদের ‘মালাই’ আসলে কী?
বাংলা হোক কি বুলগেরিয়া, দইয়ের স্বাদে তো বদল ঘটছে না। বদলাচ্ছে না এই খাবারটির প্রতি টানও। তবে ফাউ হিসেবে তা তৈরির ইতিহাস জেনে নিলে মন্দ কী! পরবর্তী ভোজে দইয়ের সঙ্গে নাহয় মিলে যাবে তারিয়ে তারিয়ে গল্প করার সুযোগও।