বাংলা ক্যালেন্ডারে ইংরেজি সালের পাশাপাশি যে বাংলা সালের হিসেব লেখা থাকে, সেই বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন কে? এই প্রসঙ্গে বারবার বিতর্ক দানা বেঁধেছে দুটি নামকে ঘিরে। মুঘল সম্রাট আকবর নাকি গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক, কে প্রকৃতপক্ষে বঙ্গাব্দের প্রবর্তক? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
বছরভর যে সাল তারিখ দিয়ে আমরা দিনের হিসেব রাখি, সকলেই জানেন তা খ্রিস্টাব্দের হিসেব। অর্থাৎ যীশু খ্রিস্টের জন্মসাল ধরে হিসেব করা। কিন্তু এর বাইরেও দুই বাংলার মানুষ পালন করেন বাংলা নববর্ষের দিনটিকেও। যেদিন থেকে শুরু হয় একটি নতুন বঙ্গাব্দ। জানেন কি, এই বঙ্গাব্দের প্রবর্তন করেছিলেন কে?
আরও শুনুন: কথায় বলে ‘পোয়া বারো’! কোথা থেকে এল এই প্রবাদ?
এ কথা খতিয়ে দেখতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে কয়েকশো বছর। আজ আমরা যে ক্যালেন্ডার মেনে চলি, তা নির্ধারিত হয় সৌরবছরের হিসেবে। সূর্যের চারদিকে পৃথিবী একবার আবর্তন সম্পন্ন করে কত দিনে, তার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক বছরের হিসেব। কিন্তু প্রাচীন বাংলায় এই হিসেব নির্ভর করত সূর্য নয়, বরং চাঁদের উপরে। বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের পর বাংলাদেশে তৎকালীন প্রচলিত শকাব্দের পাশাপাশি প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে হিজরি সনের প্রচলন শুরু হয়। চান্দ্রমাস মেনেই তৈরি হয়েছিল এই হিজরি ক্যালেন্ডার।
তাহলে বঙ্গাব্দ এল কীভাবে? ঐতিহাসিকদের মতে, হিজরি সন মোতাবেক ফসল তোলার সময়ের সঙ্গে খাজনা দেওয়ার সময় মেলানো যাচ্ছিল না কিছুতেই। অসময়ে খাজনা দিতে গিয়ে সমস্যার মুখে পড়ছিলেন চাষিরা। শেষমেশ মুঘল সম্রাট আকবর যখন ভারতের মসনদে, তখন এই সমস্যা দূর করার কথা ভাবা হল। আর এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়েই নাকি এক নতুন ক্যালেন্ডার তৈরি করেন রাজজ্যোতিষী ফতেহউল্লাহ সিরাজি। চান্দ্রমাসের আরবীয় মডেলের বদলে তিনি ব্যবহার করেছিলেন পারস্য মডেল, যা শকাব্দের মতোই সৌরমাস ধরে চলত। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে চালু হয় এই নতুন সাল। লোকমুখে তার নাম দাঁড়িয়েছিল ‘ফসলি সন’। পরবর্তী সময়ে এই ফসলি সনই বাংলা সাল বা ‘বঙ্গাব্দ’ নাম ধারণ করে বলে মনে করেছেন অনেক ঐতিহাসিক।
আরও শুনুন: বৈশাখ নয়, সেকালে বাংলার নববর্ষ শুরু হত অগ্রহায়ণেই
এদিকে আবার কেউ কেউ দাবি করে থাকেন যে বঙ্গাব্দ প্রবর্তনের কৃতিত্ব আসলে আকবরের নয়, বরং গৌড় সম্রাট শশাঙ্কের। তাঁদের মতে, ষষ্ঠ শতকের শেষ দশকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সামন্ত রাজা এবং পরে স্বাধীন গৌড়ের শাসক শশাঙ্ক নিজের শাসনকালের সূচনাকে স্মরণীয় করে রাখতে সূর্যসিদ্ধান্ত ভিত্তিক বর্ষপঞ্জি বঙ্গাব্দের সূচনা করেন। যদিও এই দাবির পালটা জবাব দিয়েছেন ঐতিহাসিক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ‘বঙ্গ, বাঙ্গালা ও ভারত’-এ তিনি লিখেছেন, “এই মতের স্বপক্ষে কিছু বলতে গেলে প্রথমেই প্রমাণ করতে হবে যে, শশাঙ্ক ৫৯৪ খ্রীষ্টাব্দে এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বা অন্তত ওই সময়ে স্বাধীন ভাবে রাজত্ব করেছিলেন। এর কোনও নিশ্চিত প্রমাণ নেই, যদিও খ্রিস্টিয় ৭ম শতাব্দীর প্রথমভাগে তাঁর রাজত্ব সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য আমাদের আছে।” তিনি আরও বলেছেন, “শশাঙ্কের রাজ্যের সর্বাপেক্ষা বিস্তৃত সীমানার মধ্যে তাঁর পরবর্তী কালীন এক হাজার বৎসরের মধ্যে তারিখ যুক্ত যে বিরাট সংখ্যক লেখ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলিতে বঙ্গাব্দ ব্যবহারের চিহ্নই নেই।” সব মিলিয়ে, বঙ্গাব্দ আসলে কে প্রচলন করেছিলেন, তা নিয়ে বিতর্ক জারি রয়েছে আজ পর্যন্ত।