করোনার আবহে দুবছর ধরেই বন্ধ বোলপুরের পৌষমেলা। বন্ধ মেলা উপলক্ষে মানুষের ভিড়ও। কিন্তু আলাদা করে কী তাৎপর্য রয়েছে এই মেলার? কেন এই মেলার টানে ভিড় জমান দূরদূরান্তের মানুষ? শুনে নেওয়া যাক কী ইতিহাস বয়ে নিয়ে চলেছে পৌষমেলা।
উৎসবের দেশ বাংলা। আর বাংলার মেঠো জীবনে উৎসবের সুর বেঁধে দেয় মেলা। তাই এখানে বিভিন্ন ঋতু উপলক্ষে জায়গায় জায়গায় মেলার ছড়াছড়ি। তার মধ্যে কেন এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে পৌষমেলা? কী এর তাৎপর্য?
আরও শুনুন: কাকা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কার্টুন এঁকেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
আসলে পৌষমেলা কেবলমাত্র এক গ্রাম্য মেলা নয়, এই মেলা ধারণ করে আছে এক ইতিহাসকেই। যে ইতিহাস ব্রাহ্ম সমাজের শুরু দিনগুলির দলিলও বটে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তখন কলকাতা তথা সারা বাংলায় হিন্দু ধর্মের জোয়ার। সেই সময়ে উপনিষদের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা, মূর্তিপূজাবিরোধী এই নতুন ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক আদানপ্রদান হওয়াটাও অত্যন্ত জরুরি ছিল। বিশেষ করে নতুন ধর্ম প্রচারের জন্যও যে এমন যোগাযোগ গড়ে তোলা দরকার, সে কথা বুঝেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। সেইজন্যই নিজের দীক্ষা নেওয়ার দিনটিতে ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যদের নিয়ে একটি মেলা আয়োজন করার কথা ভাবেন তিনি। ‘মেলা’ শব্দের অর্থ যে মিলন, বস্তুত সেই অর্থই তাঁকে চালিত করেছিল এহেন ভাবনার দিকে।
সেই থেকেই সূচনা হয় পৌষমেলার। ১৮৬০ সালের ৭ পৌষ, পলতায় গোরিটি বাগানে মেলা বসেছিল। আর শান্তিনিকেতনে উপাসনাগৃহ গড়ে তোলার পর দেবেন্দ্রনাথ নির্দেশ দিয়েছিলেন, প্রতি বছর মেলা বসবে সেখানে। অবশ্য মেলার জন্য কিছু নিয়মও বেঁধে দিয়েছিলেন তিনি। মেলায় সবরকম জিনিসপত্র বিক্রির অনুমতি দিলেও মদ এবং মাংসের উপর জারি করেছিলেন কড়া নিষেধাজ্ঞা। নিষেধ ছিল কুৎসিত আমোদ আহ্লাদ এবং পৌত্তলিকতার উপরেও। পাশাপাশি এ কথাও বলেছিলেন তিনি, মেলা থেকে যা আয় হবে, তা খরচ করা হবে মেলা কিংবা আশ্রমের উন্নতির জন্যেই।
আরও শুনুন: স্বদেশী আন্দোলনই প্রেরণা, বাঙালির ব্যবসায় জোয়ার এনেছিল সুরেন্দ্রমোহনের ‘ডাকব্যাক’
১৮৯৪ সালের ৭ পৌষ শান্তিনিকেতনে প্রথম পৌষমেলা বসেছিল। সকালের উপাসনার পরে মেলা বসেছিল ছাতিমতলা আর মন্দিরের উত্তরের মাঠ জুড়ে। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা এবং পাকাপাকিভাবে শান্তিনিকেতনে চলে আসার পরে পৌষমেলা হয়ে উঠল আশ্রমিকদের আনন্দের উৎসব। পৌষমেলায় সশরীরে শান্তিনিকেতনে উপস্থিত থাকতে চাইতেন কবিগুরু। ৮ পৌষ প্রাক্তন ছাত্রদের উৎসব আর ৯ পৌষ প্রয়াত আশ্রমিকদের শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মরণ উৎসব শুরু হয় এই আমলেই। কলকাতার শিক্ষা-সংস্কৃতি জগতের মানুষেরাও সামিল হতে থাকেন পৌষমেলায়। গ্রামের নিজস্ব সংস্কৃতি, হাতে বোনা জিনিসপত্র শিল্পের মর্যাদা পায় নাগরিক চোখেও। সেই ঐতিহ্যের গন্ধ আর সাংস্কৃতিক বয়ানের মেলবন্ধনে এখনও স্বতন্ত্র গুরুত্ব দাবি করে চলেছে শান্তিনিকেতনের এই মেলাটি।