নিজে ধর্মপরিচয়ে ব্রাহ্ম বলেই হিন্দু ধর্মে আঘাত হানছেন তিনি, এহেন অভিযোগের মুখে পড়েছিলেন খোদ সত্যজিৎ রায়। আবার সেই সত্যজিৎই নিজে লিখেছিলেন শ্যামাসংগীত। তাহলে ধর্মের পরিচয় ঠিক কেমন ছিল তাঁর কাছে?
স্বপ্নাদেশ পাওয়া গিয়েছে, বাড়ির ছোট বউ আদতে দেবী। অতএব পূজার আসনে বসাতে হবে তাকে। অন্দরমহলে আর ঠাঁই পেল না সে মেয়ে, বদলে সেকালের ঘোমটা-টানা ঘরের মেয়েকে নিমেষে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল সহস্র লোকের চোখের সামনে, প্রখর আলোয়। সে আলোর তেজে তছনছ হয়ে গেল তার গোটা জীবন। প্রভাতকুমারের গল্প অবলম্বনে এই ‘দেবী’-র ছবি গড়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। আর তা নিয়েই অভিযোগের মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে। নানা পত্রপত্রিকায় অভিযোগ উঠেছিল, নিজে ধর্মপরিচয়ে ব্রাহ্ম বলেই হিন্দু ধর্মে আঘাত হানছেন তিনি। শেষ বয়সে এক সাক্ষাৎকারে সপাটে এই অভিযোগ খণ্ডন করছেন স্বয়ং সত্যজিৎ। বলছেন, ধর্ম প্রসঙ্গে ভারতে এহেন দোষারোপ ঘটেই থাকে। কিন্তু যারা এসব বলে, তারা আদতে বোকা। তাদের কথাকে তাই সত্যিই গুরুত্ব দেওয়া চলে না। আর সেসব কথায় গুরুত্ব দিয়ে নিজের সিনেমা-দর্শনকেও যে তিনি বদলাতে রাজি নন, সে কথা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়।
আরও শুনুন:
জাত অর্থে ধর্ম নয়, বাঙালি পরিচয়েই ভরসা সত্যজিতের
আসলে সত্যজিতের কাছে তাঁর সিনে-দর্শন আর তাঁর নিজস্ব ভাবনা চিন্তার মধ্যে এক সমীকরণ টানা হয়ে ছিল। সিনেমা তাঁর কাছে কেবল পেশা মাত্র নয়, তা তাঁর নিজস্ব চিন্তা-চেতনা প্রকাশের মাধ্যম, তাঁর ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিকে বিশ্লেষণ করার পরিসর। আর সেই ব্যক্তিগত ভাবনার আকাশে নজর রাখলেই দেখা যায়, ধর্ম থেকে রাজনীতি, কোনও ক্ষেত্রেই গোঁড়ামিতেই বিশ্বাস ছিল না সত্যজিতের। ১৯৪০-৪১ সাল নাগাদ, শান্তিনিকেতন থেকে মাকে চিঠি লিখছেন কলাভবনের পড়ুয়া মানিক। যেখানে রীতিমতো রাগ দেখিয়েই বলছেন, ‘‘তোমার Blood sugar বেড়েছে জেনে বুঝলাম ওই সাধু একেবারে ভণ্ড। …তুমি আর সাধুর কথামত খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি করছ না তো?’’ ভণ্ড সাধুদের প্রতি এই রাগ স্রষ্টা সত্যজিৎ আজীবন বহন করতেন বলেই কখনও ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর মতো ছবি, কখনও আবার ‘গোঁসাইপুর সরগরম’-এর মতো কাহিনিতে ধর্মের ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিতে থাকেন তিনি।
অসহায় মানুষকে আলো, প্রাণ দেবে কোন ঈশ্বর; এ প্রশ্ন তুলে ‘আগন্তুক’-এই উৎপল দত্তের সংলাপে সত্যজিৎ স্পষ্ট করছেন ধর্ম নিয়ে তাঁর অবস্থান। সপাটে বলছেন, “কাস্ট রিলিজিয়ন ঘোর গোলমেলে… যে জিনিস মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, সেটা আমি মানি না!” পরবর্তীতে যে প্রসঙ্গ তুলে তাঁর ‘চারুলতা’-র নায়িকা মাধবীও বলেন, “আগন্তুকে মানুষের আইডেন্টিটি নিয়ে বড় কথা বলে গেছেন সত্যজিৎ রায়। ধর্ম নয়, মানুষ পরিচয়টাই তাতে বড়।” দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে সৌরীন ভট্টাচার্যও যে বলেন, “ধর্ম নিয়ে ওঁর সমালোচনা, অনেক দিক দিয়েই হিন্দুত্বের প্রবক্তাদের হজম হবে না”, সে কথার প্রমাণ সত্যজিতের কাজের ছত্রে ছত্রে। ধর্ম বা রাজনীতি, কোনও কিছু নিয়েই চড়া গলার স্পষ্ট বক্তব্য তিনি হয়তো রাখেননি সবসময়। আসলে সত্যজিতের ব্যক্তিত্বই যে যে-কোনওরকম উগ্রতাকে নাকচ করে। কিন্তু তা বলে সে প্রসঙ্গে তাঁর যে নিজস্ব মতামত ছিল না এমন তো নয়। আর নিজের কাজের মধ্যে দিয়েই সে মতামতের ছাপ তিনি রেখে যান।
‘দেবী’ বা ‘সদ্গতি’-তে যেমন ধর্মের কুপ্রথা আর নিষ্ঠুরতা নিয়ে সরব হন সত্যজিৎ রায়, তেমনই প্রান্তবেলার ছবি ‘গণশত্রু’-তে এসে তিনি খোলাখুলি বুঝিয়ে দেন, রাজনীতির সঙ্গে ধর্মব্যবসার আঁতাঁত হলে সেই সংগঠিত শক্তি কতটা বিপজ্জনক। যেখানে মন্দির-ব্যবসায়ীরা ও তাঁদের কারবারের রাজনৈতিক শরিকেরা কিছুতেই মেনে নিতে চান না যে মন্দিরের চরণামৃত দূষিত হয়ে গিয়েছে, আর সেই দূষিত চরণামৃত খেয়েই আসলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ঠিক যেমন ‘দেবী’-তে অসুস্থ শিশুকে চিকিৎসকের বদলে ফেলে রাখা হয় দৈবী মহিমার ভরসায়। মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে এভাবেই তো বেড়ে ওঠে গোঁড়ামি। আর ‘দেবী’ আসলে ধর্মকে আঘাত করেনি, আঘাত করতে চেয়েছিল এই ধর্মীয় গোঁড়ামিকেই, জানিয়েছিলেন সত্যজিৎ।
আরও শুনুন:
লেখায় পারিশ্রমিক ছবি, সিনেমায় কী করতেন সত্যজিৎ? ফাঁস করলেন ‘অপু’র নায়িকা
ধর্মের এহেন অনৈতিক ভণ্ডামি নিয়ে সত্যজিতের তীব্র বিরক্তি ছিল বটে। কিন্তু যে ধর্ম ধারণ করার কথা বলে, সেই ধর্মবোধের প্রতি কি কোনও শিল্পীর বিরাগ থাকতে পারে! তা ছিল না সত্যজিতেরও। তাই দেখা যায়, এই ‘দেবী’ ছবিতেই নিজের হাতে শ্যামাসংগীত লিখতে বাধে না তাঁর। ব্রাহ্ম হয়ে তিনি শ্যামাসংগীত লিখেছেন, তা নিয়ে ছেলেকে প্রশ্রয়ের ঠাট্টা করেছিলেন মা-ও। আসলে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বেড়াকে মান্যতা না দিলেই ধর্ম নিয়ে জলচল ভাগ করার ছুঁতমার্গ থাকে না। তাঁর লেখা গানেও রয়ে যায় ধর্মের মানবতার কথাই- “যে বলে মা তুই পাষাণী/ তারে আমি বেকুব মানি/ আমি প্রাণে জানি পাষাণের কী মহিমা/ এবার তোরে চিনেছি মা/ ও তোর নামে কালী, মুখে কালি, অন্তরে তোর নেই কালিমা।” আবার ‘আগন্তুক’ ছবিতেও উঁকি দিয়ে যায় তাঁর এই ব্যক্তিগত ধর্মের অনুভব। কৃষ্ণের নামে ধর্মীয় সমারোহের যে হুজুগেপনা বাড়িয়ে তোলে পুঁজি, তারই উলটো দিকে উৎপল দত্তের কণ্ঠে পরিচালক সত্যজিৎ স্বয়ং গেয়ে ওঠেন ‘হরিহরায় নমঃ’।
ধর্মের মোহ আর সেই মোহকে ঘিরে পুঁজির জাল, এই দুইকেই আদতে নাকচ করতে চেয়েছিলেন শিল্পী সত্যজিৎ। তাঁর নিজস্ব যে ধর্মের বোধ, তা শিল্পীর ধর্ম, তা স্রষ্টার ধর্ম। যে ধর্ম অপর মানুষের ভাবনায় আঘাত হানে না, তা বসতি পাতে মানুষের একান্ত অনুভবের বিস্ময়ে। ধর্ম নিয়ে স্লোগান না তুললেও, আজকের ভারতবর্ষের আবহে প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকে সত্যজিতের এই ধর্মবোধই।