সমসময়ের রাজনৈতিক ভাবনা থেকে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার দূরত্ব ছিল অনেকখানি। তবু রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিক। এমনকী বিগত কয়েকটি ভোটের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, অবধারিত ভাবেই ফিরে ফিরে এসেছেন তিনি, রাজনৈতিক কারণেই।
প্রচলিত অর্থে যে রাজনীতি, তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কোনোদিন সেভাবে যোগাযোগ ছিল না। রাজনীতির দরজা তাঁর কাছে রুদ্ধই ছিল। তবু রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিক। এমনকী বিগত কয়েকটি ভোটের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, অবধারিত ভাবেই ফিরে ফিরে এসেছেন তিনি, রাজনৈতিক কারণেই। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক মনীষার গঠনই অসম্পূর্ণ; আর তাই তাঁর রাজনৈতিক ধারণাকে ধারণ করতে না পারলেও প্রচলিত রাজনীতি বারবার রবীন্দ্রনাথকেই ছুঁতে চেয়েছে।
-: আরও শুনুন :-
মুসলিমদের কোরবানি আটকাতে নালিশ হিন্দু প্রজাদের, কী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন প্রশাসক রবীন্দ্রনাথ?
তাঁর সমসময়ের রাজনৈতিক ভাবনা থেকে রবীন্দ্রনাথের ভাবনার দূরত্ব ছিল অনেকখানি। জাতীয় আন্দোলনের ভিতর যে ‘অ্যাবস্ট্র্যাকশন’ ছিল বলে মনে করেন ইতিহাসবিদরা, তা দূর করার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা ছিল স্বতন্ত্র। গান্ধীজির নেতৃত্বের গুরুত্ব স্বীকার করে নিলেও, তাঁর পথটিকেই একমাত্র পথ ভাবেননি তিনি। দুজনের গন্তব্য এক হলেও, মত ও পথ ছিল আলাদা। অশোক সেন তাই বলেন, “সামগ্রিক কল্যাণে নিয়োজিত সাংগঠনিক কার্যক্রম ছাড়া কোনও গণ-আন্দোলনের নিষ্পত্তি রবীন্দ্রনাথের কাছে গ্রহণীয় মর্যাদা পায়নি। একের দিক থেকে যেটা নেতিমূলক, অনেকের সংযোগে তার কোনও পুরো গুণগত তাৎপর্য আসতে পারে সেরকম সিদ্ধান্ত সদর্থক স্বাবলম্বনে নিবিষ্ট রবীন্দ্রবিবেকের সহধর্মী নয়। তাই গান্ধীজি যে অ্যাবস্ট্র্যাকশনের অবরোধ থেকে জাতীয় আন্দোলনকে মুক্তি দিলেন, রবীন্দ্রনাথ সেই বাধা গোড়া থেকে সামাজিক পুনর্গঠন ছাড়া অনতিক্রম্য মনে করেন। তাই পল্লিসেবা, সমবায়, শিক্ষার উন্নতি ইত্যাদি প্রত্যক্ষ্য কল্যাণের মধ্যে তিনি আদর্শের অনুসরণ করেন।”
পর্বে পর্বে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনার বিবর্তন হয়েছে ঠিকই, তবে চিরকাল তার ভরকেন্দ্র ছিল মানুষের কাছে রাখা। আত্মশক্তি ও স্বাবলম্বনকে তাই বরাবর গুরুত্ব দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। দেশ বললেই যে দেশ হাতে চলে আসে এমনটা তাঁর কাছে সঙ্গত ভাবনা নয়। বরং দেশকে গড়ে তোলার কাজটা তাঁর কাঙ্ক্ষিত। ১৯০৫ সালে বাঙালিকে ডেকে এই ভিতরের দিক দেশকে সৃষ্টি করার কথাই বলেছিলেন। সেই সৃষ্টির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে আত্মশক্তি। রেনেসাঁস পর্বের সন্তান রবীন্দ্রনাথ একদা ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান-যুক্তির মধ্যে দেশের প্রাপ্তির সমূহ সম্ভাবনা দেখেছিলেন। ভারতীয় সমাজের নানাবিধ জড়তার নিরিখেই এই প্রাপ্তিকে তিনি খাটো করে দেখতে পারেননি এবং চানওনি। জীবন এগিয়েছে, বদলে গিয়েছে বিশ্বের রাজনীতি। যুদ্ধ এসেছে। একদা যা সুন্দর বলে প্রতিভাত হয়েছিল, তার কুৎসিত দিকটিও উন্মোচিত হয়েছে। ফলত রবীন্দ্রনাথ বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, “য়ুরোপীয় নব-যুগের শ্রেষ্ঠদানের থেকে ভারতবর্ষ বঞ্চিত হয়েছে য়ুরোপের সংস্রবে। নবযুগের সূর্যমণ্ডলের মধ্যে কলঙ্কের মতো রয়ে গেল ভারতবর্ষ।’ পরে সোভিয়েতের ধারণা রবীন্দ্রনাথকে ভাবিয়েছে নতুন করে। তবে দেশ ও আত্মশক্তির সম্পর্ক নিয়ে তাঁর ভাবনা কখনও অস্বচ্ছ হয়নি বলেই তিনি বলেছেন, “দেশকে পাওয়ার মানে হচ্ছে দেশের মধ্যে আপনার আত্মাকেই ব্যাপক করে উপলব্ধি করা। আপনার চিন্তার দ্বারা, কর্মের দ্বারা, সেবার দ্বারা, দেশকে যখন নিজে গড়ে তুলতে থাকি তখনই আত্মাকে দেশের মধ্যে সত্য করে দেখতে পাই। মানুষের দেশ মানুষের চিত্তের সৃষ্টি, এজন্যই দেশের মধ্যে মানুষের আত্মার ব্যাপ্তি, আত্মার প্রকাশ।’
-: আরও শুনুন :-
যাহা জল তাহা পানি নয়! ‘মুসলমানী শব্দ’ ব্যবহার নিয়ে কী মত ছিল রবীন্দ্রনাথের?
রবীন্দ্রনাথের আজীবনের কর্মও গড়িয়েছে এই খাতেই। গ্রামসমাজের প্রাণরক্ষাই তাই তিনি অবশ্যকর্তব্য বলে মনে করেছিলেন। কারণ তাঁর মতে, সমস্ত দেশ যে-শিকড় দিয়ে রস আকর্ষণ করবে তা যদি পোকায় কাটে, যে-মাটি থেকে খাদ্য পাবে, তা যদি পাথর হয়ে যায়, তাহলে আর দেশগঠন বলে কিছু থাকে না। পাবনার প্রাদেশিক সম্মিলনীতে গিয়ে স্পষ্ট করেই তাই বলেছিলেন, “গ্রামগুলিকে ব্যবস্থাবদ্ধ করো। শিক্ষা দাও, কৃষিশিল্প ও গ্রামের ব্যবহারসামগ্রী সম্বন্ধে নূতন চেষ্টা প্রবর্তিত করো; গ্রামবাসীদের বাসস্থান যাহাতে পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর হয় তাহাদের মধ্যে সেই উৎসাহ সঞ্চার করো, এবং যাহাতে তাহারা নিজেরা সমবেত হইয়া গ্রামের সমস্ত কর্তব্য সম্পন্ন করে সেইরূপ বিধি উদ্ভাবিত করো।” এ শুধু তাঁর ভাবনা নয়। উত্তরকালে শ্রীনিকেতনের মাধ্যমে এই কাজই তিনি করতে চেয়েছিলেন; গোটা দেশে যা হতে পারে, তারই একটি সংক্ষিপ্ত রূপ ছিল তাঁর কাজে, এমনটা জানিয়েছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথকে। অর্থাৎ আত্মশক্তির যে বিবিধ পরত তা রবীন্দ্রনাথের ভাবনার পাশাপাশি রূপ পাচ্ছিল তাঁর কাজেও। ‘গণদেবতার পূজা’কে তিনি শুধু তত্ত্বের স্তরে রাখেননি, বরং সেই পূজা-পদ্ধতি কী হতে পারে তা হাতেকলমেই প্রণয়ন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের নিজের কথায় তা এইরকম- ‘স্বদেশসেবায় সেই প্রথম পূজার পদ্ধতি হচ্ছে এমন-সকল অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হওয়া যাতে জনগণ সুস্থ হয়, সবল হয়, শিক্ষিত হয়, আনন্দিত হয়, আত্মসম্মানে দীক্ষিত হয়, সুন্দরকে নির্মলকে আবাহন করে আনে আপন প্রাত্যহিক জীবিকার ক্ষেত্রে, এবং যাতে আত্মরক্ষায় আত্মকল্যাণসাধনে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা রক্ষা করে সকলে সম্মিলিত হতে পারে। আমার সামান্য শক্তিতে ক্ষুদ্র পরিধির মধ্যে এই কাজে মন দিয়েছি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে।’ মানুষের জন্য, দেশের জন্য এই কাজই করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। করেওছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের নির্বাচনী ইস্তাহার কল্পনা করা হয়তো তাই বাতুলতা। তবু নির্বাচনের মুখে যখন অজস্র প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ফুটবে, তখন বাঙালির শ্রেষ্ঠ মানুষটির ভাবনা আর একবার ঝালিয়ে নিলে, লাভ বই ক্ষতি কিছু নেই।