আমব্রেলাই বলুন কি সোজা বাংলায় ছাতা, তার মতো দরকারি জিনিস আর কটা আছে বলুন তো! না হলে কি চার হাজার বছর ধরে রোদ-জল-বৃষ্টি সয়ে টিকে থাকতে পারে! হ্যাঁ, লাতিন শব্দ ‘আমব্রা’ অর্থাৎ ছায়া থেকে সাহেবি ‘আমব্রেলা’-র জন্ম দিয়েছিলেন সাগরপারের মানুষেরাই। কিন্তু শৌখিন সাহেবি হাত থেকে সেই ছাতা রোদেপোড়া-জলেভেজা বাঙালির হাতে তুলে দিল কে? আসুন, শুনে নেওয়া যাক সে গল্প।
মোহনবাগানের খেলা দেখতে একবার মাঠে গিয়েছেন বিখ্যাত শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সম্পর্কে যিনি আবার রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র। কিন্তু প্রবল বৃষ্টি, তেমনই ভিড়। গাড়ি থেকে আর নামলেন না গগন ঠাকুর। কিন্তু বাড়ি ফিরে এঁকে ফেললেন ‘মোহনবাগান’ নামের সেই বিখ্যাত ছবি। গোটা ছবি জুড়ে কেবল ছাতার সারি। বোঝা গেল, ভিড়ের চোটে মানুষের মাথা কিংবা শরীর আর চোখে পড়েনি, দর্শকের চোখে কেবল ধরা পড়েছে মাথার উপরে ধরে রাখা ছাতাগুলিই।
আরও শুনুন: স্বদেশী আন্দোলনই প্রেরণা, বাঙালির ব্যবসায় জোয়ার এনেছিল সুরেন্দ্রমোহনের ‘ডাকব্যাক’
বাঙালির সঙ্গে ছাতার সম্পর্ক এমনই ঘনিষ্ঠ। অথচ এই জিনিসটি চিনে তৈরি হয়েছিল বলেই মনে করা হয়। তার উপরে ছাতা ব্যবহার করার অধিকার ছিল কেবল সম্ভ্রান্ত মহিলাদের। সাগর পেরিয়ে সেই ছাতা বাংলায় এসে পৌঁছল কীভাবে, আর পুরুষ নারী নির্বিশেষে বাংলার আমজনতার হাতেই বা তা উঠল কেমন করে? আসছি সে কথাতেই।
বাংলায় ছাতার এহেন রমরমার পিছনে মূলত হাত ছিল আরও দুই বাঙালিরই। ব্রিটিশদের হাত ধরে নানা শৌখিন জিনিসের মতো ছাতাও এদেশে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু সেই ছাতা উচ্চবিত্ত বিলাসিতার অঙ্গ হয়েই রয়ে গিয়েছিল। এই গণ্ডি থেকে তাকে বার করে আনলেন যিনি, তাঁর নাম মহেন্দ্রলাল দত্ত। এদেশের খেটে খাওয়া মানুষও যাতে রোদজলের হাত থেকে বাঁচতে পারে, সেজন্য কম দামে ছাতা বিক্রি করার কথা ভাবলেন তিনি। আর তাই, বিদেশ থেকে আমদানি করার বদলে এই কলকাতা শহরেই তিনি খুলে বসলেন ছাতা তৈরির কারখানা। ১৮৮২ থেকে ১৯০৯ সাল, ঠিক সাতাশটা বছর সময় পেয়েছিলেন মহেন্দ্র দত্ত। তার মধ্যেই ছাতা প্রস্তুতকারক সংস্থা হিসেবে ‘মহেন্দ্র দত্ত অ্যান্ড সন্স’-কে একডাকে চিনত গোটা কলকাতা শহর। পাশে পেয়েছিলেন তাঁর সহধর্মিণী রাধারানি দেবীকেও। মহেন্দ্র দত্তের মৃত্যুর পর যখন পারিবারিক ষড়যন্ত্রে ব্যবসা বেহাত হতে চলেছে, অন্দরমহলের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন এই সদ্যবিধবা নারী। স্বামীর ব্যবসা এবং ব্র্যান্ডকে আগলে রেখেছিলেন তিনিই।
আরও শুনুন: ছাতায় ঢাকা শহরের পথ! কোথায় রয়েছে এমন আশ্চর্য রাস্তা?
কেবল মহেন্দ্রলাল দত্তই নন। ছাতার বাজার এই দেশে আরও বাড়াতে সাহায্য করেছিলেন কার্তিক চন্দ্র পাল ওরফে কে সি পাল। বঙ্গভঙ্গ আর স্বদেশি আন্দোলনের সময় দেশি ছাতা বানাচ্ছিলেন মহেন্দ্র দত্ত। আর দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন যখন পুরোমাত্রায়, মহাত্মা গান্ধীর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের হুঙ্কারে কেঁপে উঠেছে দেশ, সেই সময়েই তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে এলেন কে সি পাল। ১৯৪২ সালে জাপানি বোমা হামলার আশঙ্কার মধ্যেই ফিরলেন কলকাতায়। বাবা তুলসীদাস পালের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসার সূত্র ধরেই ছাতা তৈরি এবং বিক্রি করতে শুরু করেন তিনি। বাকিটা ইতিহাস।
ছাতা একসময়ে ছিল স্ট্যাটাস সিম্বল। আর পরবর্তী কালে বাঙালির প্রবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে, ‘শীতকালে কাঁথা আর বর্ষাকালে ছাতা’। বাঙালির সঙ্গে ছাতার দূরত্ব এভাবে ঘুচিয়ে দেওয়ার কারিগর কিন্তু এই দুই বাঙালিই- মহেন্দ্রলাল দত্ত আর কার্তিক চন্দ্র পাল।