বাঙালির কাছে জটায়ু আর সন্তোষ দত্ত কি আলাদা দুজন ব্যক্তি! ভাবতে গেলে দু-দণ্ড থমকে যেতে হয়। এই লহমাটুকুর ভিতরই রাখা অভিনেতা সন্তোষ দত্তের অমরত্ব।
পাউরুটি-ঝোলাগুড়। উত্তম-সুচিত্রা। ফেলুদা-জটায়ু। বাঙলির যুগল কল্পনায় অন্যান্য জুটির মতো শেষেরটিও অদ্বিতীয় এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
যাকে বলে, মেড ফর ইচ আদার। ফেলুদা চৌকস, মগজাস্ত্র তীক্ষ্ণ, আন্তর্জাতিক বাঙালি। জটায়ু নিপাট বাঙালি। নিজের মতো পড়াশোনা করা শান্ত, সরল গড়পারের মানুষ। মিলের মধ্যে দুজনেরই অ্যাডভেঞ্চারে ঝোঁক, অমিল এবং মতামতে গরমিলই বেশি। বলতে গেলে, দু’জনের বন্ধুত্ব যেন জমে ওঠার কথাই নয়। উঠেছিল যে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সেই সম্পর্ক বরং বেশ স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছিল, যে, বন্ধুত্ব যুক্তি-টুক্তি বা বিদ্যেবুদ্ধির ব্যাপার নয়। মনের সঙ্গে মন মিললেই মনের মানুষ। গড়পারের জটায়ু তাই শুধু ফেলুদার নয়, সব বাঙালিরই শৈশবে পাওয়া বেশ বয়সে বড় একজন বন্ধু। সন্তোষ দত্ত ছাড়া, সিনেমার ভাষায় বন্ধুত্বের সেই রসায়ন এমন ক্ল্যাসিক হয়ে উঠত কি-না, আজ কল্পনা করাও অসম্ভব। বাঙালির কাছে জটায়ু আর সন্তোষ দত্ত কি আলাদা দু’জন ব্যক্তি! ভাবতে গেলে দু-দণ্ড থমকে যেতে হয়। এই লহমাটুকুর ভিতরই রাখা অভিনেতা সন্তোষ দত্তের অমরত্ব। স্রষ্টা খ্যাতনামা, তা সত্ত্বেও জটায়ু চরিত্রের ভিতর তিনি নিজের সর্বস্ব এমন ভাবে খোদাই করে দিতে পেরেছিলেন যে, বহু তুখড় অভিনেতা জটায়ু হয়েও সন্তোষের জটায়ুকে স্পর্শ করতে পারেননি। বোধহয় করা সম্ভবও ছিল না।
এরকম তুলনা যে খুব কাজের, এমনটা বলা যায় না। প্রত্যেক অভিনেতাই স্বতন্ত্র। নিজস্ব উপলব্ধিতে তাঁরা এক একটি চরিত্রকে অনুবাদ করেন সিনেমার ভাষায়। তবে, জটায়ু ও সন্তোষ দত্ত যেভাবে সমার্থক হয়ে উঠেছে, এমন নমুনা বিরল। ফেলুদার মতোই, জটায়ু চরিত্র নিয়েও তাই আলাদা করে ভেবেছিলেন সত্যজিৎ। এদিকে যেমন সৌমিত্রর কথা মাথায় ছিল তাঁর, ওদিকে সন্তোষ দত্তের কথা তিনি ভেবেই রেখেছিলেন। ‘জটায়ু’ সন্তোষ দত্তের ‘ফেলুদা’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ই সেই সুলুক দিয়ে জানিয়েছেন, ‘সন্তোষদা চমৎকার মেজাজের বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন, প্রকৃত অর্থেই সুরসিক, সন্তোষদার সঙ্গ কখনও ভোলার নয়, কথা বললেই বুঝতে পারা যেত যে তাঁর যথেষ্ট পড়াশোনা ছিল, আমাদের দুজনের মধ্যে অত্যন্ত প্রীতির সম্পর্ক ছিল। শুধু অসাধারণ অভিনয়ক্ষমতার জন্যই নয়, মানুষ সন্তোষদাকেও মানিকদা অত্যন্ত পছন্দ করতেন।’ খেয়াল করলে দেখা যাবে, ফেলুদা-জটায়ুর বন্ধুত্বের নেপথ্যে ঠিক যা যা ছিল, তাই-ই যেন ছিল সন্তোষ দত্তের মধ্যেও। জটায়ু চরিত্রে রক্তমাংসে প্রাণপ্রতিষ্ঠা তাই তাঁর হাতে ছাড়া আর কার হাতেই বা হতে পারত! ইতিহাস সাক্ষী দেয়, সত্যজিৎ নির্ভুল এবং অভ্রান্ত ছিলেন।
সন্তোষ দত্ত যে শুধু জটায়ু চরিত্রকে আশ্চর্য জ্যান্ত করে তুলেছিলেন তাই-ই নয়; তাঁর বলা সংলাপকে তিনি বঙ্গজীবনের অঙ্গ কর দিয়ে গিয়েছেন বলা যায়। ‘তাং মাত করো’, ‘আপনি কি শুয়োর’ ‘কোনও প্রশ্ন নয়’ বলার সেই অনুনকরণীয় ভঙ্গি বা উট সম্পর্কে সেই বিখ্যাত সেই প্রশ্ন ‘কাঁটা কি এরা বেছে খায়?’- এর মতো এমন বহু সংলাপ তাঁর উপস্থাপনার গুণে বাঙালির কথার লব্জ হয়ে উঠেছে। খেয়াল করার মতো বিষয় যে, সন্তোষ দত্ত কিন্তু কখনোই নায়ক চরিত্রে অভিনয় করছেন না। তিনি কৌতুকের স্নিগ্ধতাই ছড়াচ্ছেন, তবে তার ভিতর কাতুকুতু নয়। এই একই ঘরানার ছাপ পাওয়া যাবে রবি ঘোষ এবং অনুপ কুমারের বিশেষ বিশেষ অভিনয়ে। সৌভাগ্য বলতে হয় যে, তপন সিংহ এবং তরুণ মজুমদারের মতো পরিচালক বাংলার দুই অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৌতুক-অভিনেতা মুখ্য চরিত্র করে সিনেমা করেছেন। আমরা পেয়েছি ‘গল্প হলেও সত্যি’ বা ‘পলাতক’-এর মতো ছবি।
তুলসী চক্রবর্তী যেমন ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ বা ‘চাওয়া-পাওয়া’র, তেমন ‘পরশপাথর’-এরও বটে! সন্তোষ দত্ত আলাদা করে কেন্দ্রীয় চরিত্র পাননি। সন্দেহ নেই, ফেলুদার কাহিনিতে তাঁর ভূমিকা অনেকখানি। তবু, ফেলুদাই তো সেখানে মুখ্য। অথচ জটায়ু হয়ে যে পরিমিত অভিনয়ের ছাপ তিনি রেখেছেন, তা বাংলা সিনেমার ঘরানায় আলাদা মাত্রা বহন করে। সন্তোষ দত্ত বোধহয় খুব সচেতন ভাবেই প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, কমেডি রিলিফ মাত্র নয়। তা জীবনের অপরিহার্য অংশ। সুরসিক মানুষ হওয়ার দরুনই বোধহয়, তাঁর পাওয়া চরিত্রগুলোকে তিনি এমন এক ভঙ্গিমার আদল রচনা করেছিলেন, যা একেবারে মৌলিক। বাঙালি অতএব সন্তোষ দত্তের আশ্রয়েই পেয়ে গিয়েছে তার নিজস্ব অভিব্যক্তি। একজন চরিত্রাভিনেতার কাছে বাঙালির সেই ঋণ অনস্বীকার্য।
কৌতুক অভিনেতা হিসাবে তাঁর পরিচয় ধরে নিয়েই যদি হাল্লা রাজা বা শুন্ডির রাজার দিকে তাকানো যায়, তাহলে অন্য এক তাৎপর্য চোখে পড়ে। সুকুমার রায় স্বয়ং তাঁর রাজা চরিত্রদের খানিক অন্যরকম ভাবেই নির্মাণ করেছিলেন। রাজার পরাক্রম যেন খানিকটা হাসিরই উদ্রেক করে। সত্যজিৎ যখন প্রবল পরাক্রমশালী হীরক রাজাকে তৈরি করেন, সেখানেও প্রচ্ছন্ন থেকে যায় কৌতুক। প্রায় যেন সেই অনুষঙ্গেই রাজার চরিত্রে এলেন সন্তোষ দত্ত। বাংলা সাহিত্যে রাজা চরিত্র নির্মাণের এই যে একটি দিক, তা শরীরী ভঙ্গিতেই প্রকাশ করে দিয়েছিলেন তিনি। সত্যজিতের ছবি বাদ দিলে আরও বহু চরিত্রেই অভিনয় করেছেন। স্বল্প পরিসরই পেয়েছেন, তবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, চরিত্রের ভিতর প্রাণের সঞ্চার ঘটানো সময়ের অপেক্ষা করে না। করে, অভিনেতা সেই চরিত্রটিকে কীভাবে অনুধাবন করছেন তার উপর। সন্তোষ দত্তের সবথেকে বড় দান বোধহয় সেটাই। তিনি বাংলা ছবিতে চরিত্রাভিনেতার স্থানকেই অন্য উচ্চতায় আসীন করেছেন। সন্তোষ দত্ত অনুনকরণীয়, তবে তাঁর ঘরানা বাংলা ছবিকে পুষ্টিই জুগিয়েছে। সে-ঘরানার মূলসুর বাঙালির নিজস্বতায়।
আজ বেচাল সময়ের বাঙালিয়ানা যখন নানা প্রশ্নের মুখে পড়ে, তখন বাঙালি খানিক বেসামাল। আর এই দুর্দিনে যেন নতুন মাত্রায় ধরা দিচ্ছেন সন্তোষ দত্ত। একজন নিখাদ বাঙালি যিনি তাঁর বাঙালিয়ানা নিয়ে লজ্জিত নন। জানার দাম্ভিকতা নেই, বরং অজানাকে জানার কৌতূহল আছে। আর আছে নিজেকে ধরে রাখার আশ্চর্য ক্ষমতা। অন্যের গ্লোরি তাঁকে ফিকে করে না। বরং তাঁর খামতিটুকু নিয়েই তাই জোরদার। বাঙালিজীবনে সন্তোষ দত্তকে আজ তাই আয়না বললে ভুল হয় না। কেউ যদি আজ বাঙালিয়ানা নিয়ে তাই জোরাজুরি করে, বাঙালি একমাত্র সন্তোষ দত্তের অনুসারী হয়েই অবলীলায় বলে উঠতে পারে- ‘তাং মাত করো, জাদা হো গয়া, কাফি হো গয়া!’
তাঁকে তাই কাল্টিভেট করাই হবে শতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য।