যা কিছু চলে যায়, তা নিয়েই বাঙালির নস্টালজিয়া জেগে ওঠে। সে সিঙ্গল স্ক্রিন হোক কি ট্রাম। কোনও কিছু রেখে দেওয়ার জন্য কী করা জরুরি, তা নিয়ে অবশ্য তার মাথাব্যথা নেই। তার যাবতীয় ঐতিহ্যের মাথায় সারাবছর পাখিরা বর্জ্য ত্যাগ করে যাবে, নির্বিকার উদাসীনতায় বাঙালি তার দর্শক হয়ে থাকাই অভ্যাস করে ফেলেছে। কলকাতা থেকে ট্রামের হারিয়ে যাওয়া দুঃখের, কিন্তু মৃত্যুঘণ্টা পড়ার আগে বাঙালি তা নিয়ে আদৌ সচেতন হয়েছিল কি?
২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪। সকাল সকাল বাঙালির মেলোট্রামা শুরু। কেননা সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাঙালি জানতে পারল, এদিন থেকেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ট্রাম। সব জ্ঞানের মতোই, এই নবলব্ধ জ্ঞানও সে পেল ফেসবুক থেকেই। আর অমনি প্রেম থেকে পলিটিক্স, ট্রামের সঙ্গে জীবনের সব তার জড়িয়ে উপচে পড়ল তার নস্টালজিয়া। যদিও রাস্তায় ট্রামলাইন সাজার গো-অ্যাজ-ইউ-লাইকেই এতদিন তার সকল ট্রাম-প্রীতি আটকে ছিল। সে লাইনে ট্রাম আদৌ আসে যায় কি না, জীবনানন্দের মৃত্যুদিন ছাড়া সে প্রসঙ্গও ছিল অবান্তর। কিন্তু ট্রামের মৃত্যুঘণ্টাটি যেইমাত্র পাকাপাকিভাবে পড়ে গেল, তখনই কী নেই কী নেই করে ঘুম ভেঙে গেল তার- জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার সেই লোকটির মতোই।
যা কিছু চলে যায়, তা নিয়েই বাঙালির নস্টালজিয়া জেগে ওঠে। সে সিঙ্গল স্ক্রিন হোক কি ট্রাম। কোনও কিছু রেখে দেওয়ার জন্য কী করা জরুরি, তা নিয়ে অবশ্য তার মাথাব্যথা নেই। তার যাবতীয় ঐতিহ্যের মাথায় সারাবছর পাখিরা বর্জ্য ত্যাগ করে যাবে, নির্বিকার উদাসীনতায় বাঙালি তার দর্শক হয়ে থাকাই অভ্যাস করে ফেলেছে। সুতরাং কলকাতার ট্রামের ভাগ্যেও অন্যরকম কিছু হওয়ার কথা ছিল না। বাঙালির সদ্যজাগ্রত নস্টালজিয়া দেখে জয়াশিস ঘোষ যে কয়েক লাইন লিখেছেন, ট্রামের জীবনে তা-ই একান্ত সত্য-
“ট্রামের মৃত্যু নিয়ে
শোকপ্রস্তাব রচনা করেনি কেউ
অথচ, একের পর এক ট্রাম মরে গেছে
এই কলকাতায়—
শেষযাত্রায় মৃতদেহ নিয়ে উল্লসিত
কতিপয় বাঙালি
বাকি যারা চালক, খালাসি
হাত বুলিয়েছে চামড়া ওঠা শরীরে —
দুধ ফুরিয়ে যাওয়া গাভীটি যেন!”
অথচ বাঙালির সেকালে এই ট্রামেরই কী কদর! এ শহরটার গড়ে ওঠা, ছড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে গত দেড়শো বছর ধরে জড়িয়ে আছে ট্রামকাহিনি। ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় প্রথমবার ট্রামের চলা শুরু। বিদ্যুতের তার টেনে নয়, ঘোড়ার খুরে তাল মিলিয়ে। শিয়ালদা থেকে শুরু করে বৌবাজার, ডালহৌসি স্কোয়ার হয়ে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত তার সীমা। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেই ট্রাম অবশ্য বেশিদিন চলেনি। ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ নভেম্বর, এইটুকুই ছিল কলকাতার প্রথম ট্রামের পরমায়ু। ১৮৮০-র ১ নভেম্বর লর্ড রিপনের হাতে নতুন করে পরিষেবার উদ্বোধন হল বটে, কিন্তু তখনও গণপরিবহণের ট্রাম যেন যাত্রীদের নিজস্ব যান। তাঁরা যেখান থেকে ইচ্ছে ওঠেন, যেখানে ইচ্ছে নেমেও পড়েন। তবে উচ্চবিত্ত নয়, মূলত মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত বাঙালিরই পরিবহণের বড় ভরসা হয়ে দাঁড়ায় ট্রাম। শিবরাম চক্রবর্তী যেমন ‘স্বামী হওয়ার সুখ’ গল্পে এক চরিত্রকে দিয়ে বলান, “আপিস বেরোবার মুখে কী করে ট্রামে চাপব শুধু এই এক সমস্যা ছাড়া আর কোনো চিন্তা আমাদের মনে স্থান পায় না।” আমজনতার সাধ্যে কুলোয় বলেই ট্রাম যে ভিড়ে ভিড়। সেকালের কলকাতার কেরানি বাঙালি অফিসে যায় আসে ট্রামে চড়ে, আবার ছুটির দিনে বেড়াতে বেরোলেও তার সাধ্য ট্রামের সস্তা টিকিটেই আটকে থাকে। ট্রামের ভাড়া বাঁচিয়েই সে কখনও বউয়ের খোঁপার মালা কেনে, কখনও বা ওষুধ। তাই ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বাড়লেও কলকাতাকে আন্দোলনে নামতে হয়। ১৯৫৩ সালে বিধান রায়ের সরকারের বিরুদ্ধে সে আন্দোলনে হাজির ছিলেন জ্যোতি বসুরা। আরও পরের বাঙালি অবশ্য গণ-প্রতিবাদের ধার ধারে না, সে স্রেফ কন্ডাকটরের সঙ্গে কম পয়সায় ভাড়া রফা করতে চায়।
ভাড়া দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে অবশ্য ট্রামের সঙ্গে বরাবরই একরকমের অম্লমধুর সম্পর্ক ছিল বাঙালির। ১৮৮০ সালেই এক বিবরণ বলছে, কন্ডাকটর অতিরিক্ত যাত্রী তোলায় বিডন স্ট্রিট থেকে ট্রামে উঠে পুলিশ কোর্ট পর্যন্ত পুরো রাস্তা বাবু আহুরলাল সেনকে দাঁড়িয়ে যেতে হয়েছিল। নামার সময় তাই ভাড়া দিতেই আপত্তি জানালেন তিনি। সেই নিয়ে বাগবিতণ্ডার জল গড়াল আদালতে। কিন্তু প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে বিচারপতি রায় দিলেন, ভাড়া না দিয়ে যাত্রী কোনও অন্যায় করেননি। কেন-না, যাত্রীর সুবিধা অসুবিধার দিকে খেয়াল রাখা তো ট্রাম কর্তৃপক্ষেরই কর্তব্য।
মুশকিল হচ্ছে, বহুদিন সে কথা ভুলে গিয়েছেন ট্রামের মালিক ও সওয়ারি দুই পক্ষই। তাঁদের মধ্যে বাঙালি তো রয়েছেনই, যাঁরা বাঙালি নন তাঁরাও বাংলার বাসিন্দা তো বটেই। অন্য সুবিধার কথা ছেড়েই দিই, দেড়শো বছর পেরিয়ে যাত্রীদের দ্রুত যাতায়াতের সুবিধাটুকুও যে ট্রাম দিয়ে উঠতে পারছিল না, তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিল না। যে বাঙালি ট্রামের ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে প্রতিবাদ করত, ট্রামের গতি কমে যাওয়া নিয়ে তারও মুখে কুলুপ। ফলে অন্যান্য দ্রুতগামী যানবাহনের ভিড়ে ট্রাম ক্রমশ পিছিয়েই পড়েছে। অথচ পরিবেশবান্ধব এই যানকে অন্য কোনও উপায়ে কাজে লাগানো সম্ভব কি না, সে কথাও ওঠেনি কোথাও। মহানগরীর গতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা বুড়ো ট্রাম বরাবরের মতোই সুতরাং পাড়ি দিল ঘুমের দেশে। বিশ্বায়নের বাঙালি যাকে নেহাতই অপ্রয়োজনীয় করে রেখেছিল, তাকে নিয়ে নস্টালজিয়াতেই বা কাজ কী!