মর্যাদাপুরুষোত্তম রামচন্দ্র। বাংলার প্রদেশে প্রদেশে তিনি জড়িয়ে আছেন বহু রূপে, বহুত্বের স্বরূপে। তারই সন্ধানে সংবাদ প্রতিদিন শোনো-র বিশেষ নিবেদন ‘রামচরিত’।
দ্বিতীয় পর্বে থাকল কৃত্তিবাস থেকে সুকুমার পর্যন্ত বাংলার রামায়ণ চর্চার বহু ধারার খোঁজ।
লিখলেন, রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
বাড়ির মহিলামহল থেকে চাকরদের আসর, সব জায়গাতেই রামায়ণ গানের অবাধ আনাগোনা। কখনও ভৃত্যের মুখে কৃত্তিবাসের রামায়ণ কথা বালকের মন কেড়ে নেয়, কখনও আবার কৃত্তিবাসী পয়ারকে হারিয়ে দেয় দাশু রায়ের অনুপ্রাস-অলঙ্কারে ভরা পাঁচালি। কিন্তু বাংলায় লেখা সেই চেনা গান পেরিয়ে বাবার কাছে খোদ বাল্মীকি রামায়ণ পড়ে এসেছেন, এই খবর দিয়েই মাকে চমকে দিয়েছিলেন শিশু রবীন্দ্রনাথ। এ ঘটনার অনেক আগেই অবশ্য দিদিমার ছেঁড়াখোঁড়া কৃত্তিবাসী রামায়ণটিও হস্তগত করেছিলেন তিনি। কিন্তু কোনও করুণ বর্ণনা পড়ে কেঁদে ফেলা মাত্রই হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল সে বই।
বাঙালি তো এমন রামকেই চিনেছিল, যিনি নিজে কাঁদেন, কাঁদানও। স্ত্রীকে হারিয়ে বিলাপ করতে যাঁর বাধে না। যিনি ভাইকে আগলে রাখেন নিজের সবটুকু দিয়ে। আর এই মানবিক ছোঁয়া রামকে বাঙালির ঘরেরই চেনা আত্মীয় করে রেখেছিল। ব্রাহ্ম পরিবারে বড় হওয়া রবীন্দ্রনাথের শৈশবেও যে রামায়ণের এমন যোগ, তা আসলে বাংলার মূল সুরটিকেই চিনিয়ে দেয়। এই রাম যতখানি ধর্মের, তার চেয়ে অনেক বেশি সংস্কৃতির।
রাম এমন করে বাঙালির মনোভূমির বাসিন্দা হয়ে ছিলেন বলেই, রামের জন্মভূমি নিয়ে আলাদা করে মাথাব্যথার তাৎপর্য ছিল না তার কাছে। যুদ্ধবিগ্রহ, দেশ জয়, শত্রুর বিনাশ- এসব কথা তো সব মহাকাব্যেরই লক্ষণ। কিন্তু কাব্যের নায়কের মধ্যে বাল্মীকি কোন গুণ খুঁজছেন, সেই প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ প্রথমেই প্রশ্ন রাখেন– “কহ মোরে বীর্য কার ক্ষমারে করে না অতিক্রম”। তাঁর সমসাময়িক বিবেকানন্দও রামের শৌর্যের চেয়ে বড় করে দেখছেন তাঁর গ্রহিষ্ণুতাকেই। বাল্মীকি পড়া, কৃত্তিবাসে সিঞ্চিত, শ্রীরামকৃষ্ণের রামলালার প্রতি ভক্তির প্রভাবে পরিচালিত বিবেকানন্দ রামের উপর পাশ্চাত্যের যুদ্ধবাজ মডেল চাপাতে নারাজ। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য রচনার শেষে তিনি লিখছেন, “রামায়ণ কি না আর্য্যদের দক্ষিণি বুনো-বিজয়!!… কোন্ গুহকের, কোন্ বালির রাজ্য, রামচন্দ্র ছিনিয়ে নিলেন— তা বল না?”
যাবতীয় শৌর্যবীর্যের আড়াল দিয়ে ঘরের কথাই রামায়ণে বড় আকার নিয়েছে, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, ব্যক্তির কর্তব্যকে তা গুরুত্ব দিয়েছে- এভাবেই রামায়ণকে চিনতে চেয়েছিল বাংলা।
আসলে যাঁর হাত ধরে সংস্কৃতের রামকথা বাংলায় সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে, সেই কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রামকে গড়ে নিয়েছিলেন তাঁর চেনা প্রতিবেশের আদলেই। তাঁর আগেও বাংলায় রামকথার চর্চা ছিল না এমন নয়। বঙ্গভূমেই লেখা হয়েছিল অভিনন্দের ‘রামচরিত’। সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ দ্ব্যর্থবোধক, কিন্তু তার বাইরের অর্থটি রামায়ণকেই অবলম্বন করেছিল। কিন্তু বাল্মীকির ধীরোদাত্ত মর্যাদাপুরুষোত্তম রামের মধ্যে কৃত্তিবাস যে মানবিক গুণ জারিয়ে দিলেন, প্রেম-বিরহ-কান্না-রাগ সব মিলে সে রামকে যেন অনেকখানি নাগালে পাওয়া গেল।
-: আরও শুনুন :-
রামচরিত: বাংলার আছে নিজস্ব ‘অযোধ্যা’, এখনও বইছে ক্ষীণস্রোতা ‘সরযূ’
কৃত্তিবাসের হাত ধরেই বাংলা ভাষায় রামায়ণ চর্চার পথটি খুলে গিয়েছিল। সংস্কৃতের রামায়ণকে পাওয়া গেল প্রাদেশিক ভাষা বাংলায়, সেখান থেকে বাংলার নানা উপভাষাতেও আরও লৌকিক চেহারা নিয়ে হাজির হতে থাকল রামকথা। তা কখনও নিতান্তই মৌখিক টেক্সট, কখনও আবার পাকা লেখা। এই যেমন জগদ্রামী রামপ্রসাদী রামায়ণ বলে আরও এক রামায়ণের খোঁজ মেলে বাংলায়। আঠেরো শতকে এই রামকথা লিখেছিলেন বাঁকুড়া জেলার পিতাপুত্র জগদ্রাম (মতান্তরে জগৎরাম) ও রামপ্রসাদ। সাত নয়, আট কাণ্ডে বিভক্ত এই রামায়ণ, পুষ্কর কাণ্ড শীর্ষক অষ্টম কাণ্ডে রয়েছে সহস্রস্কন্ধ রাবণ বধের উল্লেখ। বাঁকুড়া অঞ্চলের নিজস্ব কথনরীতিকেই অনুসরণ করেছিল এই রামায়ণের ভাষা।
অনুমান করা যায়, পঞ্চদশ শতক নাগাদ ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ লিখেছিলেন কৃত্তিবাস। আর সতেরো শতকে ময়মনসিংহের গ্রামীণ চারণ নয়ানচাঁদ ঘোষের ‘চন্দ্রাবতী’ কাব্যে পাওয়া গেল চন্দ্রাবতী রামায়ণের উল্লেখ। চন্দ্রাবতী ষোড়শ শতকের কবি। প্রেমিকের বিশ্বাসঘাতকতা ভুলতে পিতার নির্দেশে রামায়ণ লিখেছিলেন তিনি। সম্পর্কের হাত ধরে যে দুঃখ আসে, রামায়ণে সেই দুঃখ ঘন হয়ে উঠেছিল বলেই কি ব্যাকুল কন্যাকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন কবি দ্বিজ বংশীদাস? সে কথা জানার পথ নেই, তবে এই সংশয় মনে করিয়ে দেয় তাঁর উত্তরসূরি আরেক কবিকে। দুঃখের সূত্রটি ধরেই রামায়ণ প্রসঙ্গে তেমনই এক ভাবনা রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কাব্যের নায়ক কে হতে পারেন, বাল্মীকির জবানিতে নারদের কাছে সে প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনিই—
কে পেয়েছে সবচেয়ে, কে দিয়েছে তাহার অধিক,
কে লয়েছে নিজশিরে রাজভালে মুকুটের সম
সবিনয়ে সগৌরবে ধরামাঝে দুঃখ মহত্তম…
চন্দ্রাবতী অবশ্য রামের দিকে আলাদা করে নজর দিতে চাননি। কিন্তু রামায়ণ জুড়ে সর্বংসহা সীতা যে দুঃখ বয়ে চলেছিলেন, নিজের দুঃখের মাঝে দাঁড়িয়েই তাকে চিনেছিলেন তিনি। খানিক ব্রতকথা ও লোকগানের ছাঁচে ঢালা এই রামায়ণ বাল্মীকি ও কৃত্তিবাসের পাঠ থেকে অনেকখানিই আলাদা। সীতার অতিপ্রাকৃত জন্মকথা দিয়ে শুরু করে সীতার বারোমাসির সূত্রে তাঁর সমস্ত দুঃখময় জীবনটিকেই ধরতে চেয়েছে চন্দ্রাবতী রামায়ণ। ‘চন্দ্রাবতী কয় রাম গো তোমার বুদ্ধি হইল নাশ’— এই বলে সীতা প্রসঙ্গে রামকে কার্যত ভর্ৎসনা করার সাহসও দেখিয়েছেন চন্দ্রাবতী। রাম রাবণের যে বিরাট যুদ্ধে রামের শৌর্য তার শীর্ষে পৌঁছেছে, এখানে সীতার সামান্য কয়েক পঙ্ক্তির বয়ানে হারিয়ে গিয়েছে সেই যুদ্ধ এবং রামের গরিমার আড়ম্বরও।
একজন নারীর কলমে রামকথার পুনর্নির্মাণ শুধু বাংলা কেন, সারা ভারতের রামচর্চার প্রেক্ষিতেও ব্যতিক্রমী। চন্দ্রাবতীর প্রায় তিনশো বছর পরে, তাঁর পথ ধরেই যেন একটি কবিতায় রামের দিকে আঙুল তুলেছেন উনিশ শতকের মহিলা কবি উপেন্দ্রমোহিনী। ১৮৬৭ সালে বামাবোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত এই কবিতায় তাঁর সাফ অভিযোগ—
অবগত আছে সবে কৌশল্যা নন্দনে
বিনা দোষে দিয়াছিল জানকীরে বনে।।
আসলে অন্য মহাকাব্যের মতোই রামায়ণের কাহিনিও ক্ষত্রিয়সমাজের কাহিনি, তা জুড়ে রয়েছে যুদ্ধের গল্প, পুরুষের আধিপত্য। সেখানে মেয়েদের মুখে কিংবা মেয়েদের কলমে যখনই রামকথা ঠাঁই পেয়েছে, সেখানে তৈরি হয়েছে ওই আধিপত্যের এক পালটা বয়ান। বাংলার মেয়েদের মৌখিক রামগানে, চন্দ্রাবতী রামায়ণে, এমনকি একেবারে আধুনিক কালে নবনীতা দেবসেনের লেখা সীতাকেন্দ্রিক গল্পগুলিতেও জেগে আছে সেই একইরকম দেখার চোখ। আর তার সঙ্গেই জারি আছে মর্যাদাপুরুষোত্তম রামচন্দ্রের প্রতি একাধিক প্রশ্নও।
নারীর চোখে রামায়ণকে দেখা যেমন বাল্মীকি রামায়ণের থেকে পালটে গিয়েছে, তেমনই বাংলা মৌলিক সাহিত্য আবার তুলে ধরেছে আরও এক রামায়ণকে। ইংরেজিশিক্ষিত বাঙালির জন্য, রেনেসাঁর আধুনিক চোখে রামায়ণের পুনর্নির্মাণ করেছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ রামের তুলনায় বেশি নায়কোচিত গুরুত্ব পেয়েছেন রাবণ। রবীন্দ্রনাথ এই কাব্যের কড়া সমালোচনা করেছেন বটে, কিন্তু প্রচলিত রামভাবনার বিরোধী বলেই এই কাব্যকে নাকচ করতে হবে, এমন ডাক ওঠেনি সেকালের বাঙালি সমাজে।
আবার রাজশেখর বসু যখন বাল্মীকি রামায়ণের সারানুবাদ করছেন, তার ভূমিকায় তিনি স্পষ্টই সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, রামায়ণের কোনও কোনও ঘটনা আধুনিক সংস্কারের বিচারে অনৈতিক। রামায়ণের সারানুবাদ করেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীও, কেবলমাত্র শিশুদের পাঠের উপযোগী করে। শিশুদের জন্য নয় লাইনে একটি রামায়ণ লিখেছিলেন ‘বাল্য শিক্ষা’ পুস্তকের প্রণেতা রামসুন্দর বসাক। কিন্তু অনুবাদের সীমা পেরিয়ে বাংলা শিশুসাহিত্যে যে রামায়ণের আনাগোনা, সেখানে মহাকাব্যকে নিয়ে ছেলেমানুষি কম নেই। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রামায়ণী কথা’ খুদ্দুর যাত্রা, সেই নব রামায়ণে কথার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রয়েছে নানা কিসিমের ফোটোগ্রাফ, পোস্টার, পঞ্জিকা-খবরের কাগজ-পত্রিকা-দেশলাইবাক্স থেকে কাটাকুটি করা বিজ্ঞাপন ও ছবি। সেতু বন্ধনের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে সিমেন্ট সংস্থার বিজ্ঞাপন। লঙ্কায় যুদ্ধের প্রসঙ্গে উঠে আসছে সেই সময়ে ঘটে চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের টুকরো টুকরো ছবি- মস্কোর রেড স্কোয়ারে লাল ফৌজের কুচকাওয়াজ, কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতুড়ি-কাস্তে সংবলিত পোস্টার। লঙ্কার রথতলায় পুষ্পক রথের চালক পবন পুত্র হনুমানকে জানান, “এই স্থানটারে কয় নিউ এয়ারপোর্ট”। লীলা মজুমদারের ‘লঙ্কাদহন পালা’-য় বিস্কুট দিয়ে খুদে রাক্ষসের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেছেন খোদ হনুমান। সুকুমার রায়ের ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’-এ আবার রাম যুদ্ধকে এড়িয়েই যেতে চান ক্রমাগত। ‘রাবণের শক্তিশেল’ নামে এর নবনির্মাণ করেন মতি নন্দী, যেখানে যুদ্ধের আগে রাম কৃত্তিবাস আওড়ালে তাকে রীতিমতো ধমকেই দেন অনুজ লক্ষ্মণ। কিন্তু রামকে নিয়ে এমন ছেলেমানুষির কথা ভাবতে দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাঙালি লেখক বা পাঠক কারোরই সমস্যা হয়নি। তাই সেই বাংলায় যখন সাম্প্রতিক কালে ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’ উদ্ধৃত করে হুমকির মুখে পড়তে হয়, তখন ভক্তির এই প্রবল আবহটিই বড় অপরিচিত ঠেকে বাঙালির বড় অংশের কাছেই।
আসলে বাংলায় রামের কোনও একমাত্রিক মূর্তি যে ছিল না, এমন ভিন্ন ভিন্ন বয়ান থেকেই সে কথা প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। তাঁকে নানাভাবে গ্রহণ করা যায়, তাঁকে নানাভাবে বিরুদ্ধ প্রশ্নও করা যায়, আর এক রামের কাজের বিরুদ্ধে সেই প্রশ্নটিও তোলা যায় আরেক রামের ভাবনা দিয়েই- এমনই এক পরিসর খোলা ছিল বাঙালির মনোভূমিতে। আসলে যে মহাকাব্য দেবভাষা সংস্কৃতে লেখা হয়েছিল, দেবভাষার গণ্ডি মেনেই তাতে সাধারণের নাগাল থাকার কথা তো ছিল না। কিন্তু প্রাদেশিক ভাষায় তাকে অনুসৃজন করতে করতে আসলে সেই বেড়াকেই ভেঙে দিয়েছিলেন কৃত্তিবাসের মতো কবিরা। আর সেখানেই ভেঙে গিয়েছিল রামের একমাত্রিকতার বয়ানও। যুগের পর যুগ পেরিয়ে মানুষের মুখে মুখে যে গান বেঁচে রইল, মুখে মুখে এভাবে ছড়িয়ে পড়ার কারণেই তার কোনও একটিমাত্র নির্দিষ্ট রূপ থাকাও আর সম্ভব হল না। আদি কবির রচনাকে পুঁজি করেই তাতে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে দিলেন বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন কালের কবিরা। বাল্মীকি রামায়ণের সূত্রে এ কাহিনির অন্তিম পরিণতি তাঁদের প্রথম থেকেই জানা, কিন্তু সেই গন্তব্য অক্ষুণ্ণ রেখেও তার মাঝে মাঝে নিজস্ব ভাবনা বুনে চললেন তাঁরা। আর তার ফলেই রামকথা আর একটিমাত্র রইল না, তা হয়ে উঠল বহু, বিচিত্র- ঠিক সেকালের ভারতবর্ষেরই মতো।