যুদ্ধের সঙ্গে মহামারীর সম্পর্কটা বড় বেশি ঘনিষ্ঠ। স্প্যানিশ ফ্লু, প্লেগ, কলেরা, সব মহামারীর ক্ষেত্রেই সে কথা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু আরেকদিকে রোগের ভয়াবহতার প্রকোপেই চিকিৎসাশাস্ত্রে ঘটে গিয়েছে একেকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। শুনে নেওয়া যাক তেমনই একটি আবিষ্কারের কথা, যা আজকের দিনেও চিকিৎসাক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি এক উপাদান বলেই স্বীকৃত।
কথায় বলে, নেসেসিটি ইজ দ্য মাদার অফ ইনভেনশন। প্রতিকূলতা মানুষকে বাধ্য করে নতুন নতুন পথ খুঁজে নিতে। আজকের দিনে প্রায়ই যে ORS-এর শরণাপন্ন হতে হয় আমাদের, তার আবিষ্কারের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এমনই এক প্রতিকূল পরিস্থিতি। আর জড়িয়ে আছেন তিন বাঙালি। যাঁদের কথা সেভাবে মনেও রাখেনি কেউ। অথচ তাঁরা না থাকলে এই বিশেষ স্যালাইনটি ইঞ্জেকশনের বদলে সহজ ওরাল সলিউশন হিসেবে আমাদের হাতে পৌঁছত না আদৌ।
আরও শুনুন: স্বদেশী আন্দোলনই প্রেরণা, বাঙালির ব্যবসায় জোয়ার এনেছিল সুরেন্দ্রমোহনের ‘ডাকব্যাক’
কীভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল আধুনিক চিকিৎসার অত্যন্ত চেনা এই নিদান? সে কথাই বলা যাক।
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, সেই সময়ই সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়িয়ে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ে কলেরা রোগ। সেটা গত শতকের সত্তরের দশক। পাকিস্তানি রাজাকারদের হত্যালীলার সামনে পালটা লড়াই দিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা। খাবার জোটে না, যেখানে সেখানে লুকিয়েচুরিয়ে থাকতে হয়। এদিকে যাঁরা কাঁটাতার পেরিয়ে পালিয়ে আসছেন ভারতে, তাঁদের গতি হচ্ছে রিফিউজি ক্যাম্প। সেখানেও চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশ। না আছে ঠিকমতো পানীয় জলের জোগান, না আছে শৌচাগারের ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে ডায়রিয়া আর কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দিল অচিরেই। এদিকে এই রোগের ফলে শরীরে যে ডিহাইড্রেশন ঘটে যায়, তা মোকাবিলা করার উপায় বাইরে থেকে রিহাইড্রেট করা, অর্থাৎ প্রয়োজনীয় জল শরীরে ফিরিয়ে দেওয়া। কিন্তু তার জন্য যে স্যালাইন দিতে হবে, তখন তা দেওয়া হত একমাত্র ইন্ট্রাভেনাস পদ্ধতিতে। অর্থাৎ শিরায় সুচ বিঁধিয়ে শরীরে প্রবেশ করানো ছাড়া স্যালাইন দেওয়ার আর কোনও পথ জানা ছিল না। কিন্তু ওই অবস্থায় তার পর্যাপ্ত জোগান মিলবে কীভাবে? আর এই সময়ই এগিয়ে এলেন এক বাঙালি গবেষক। দিলীপ মহলানবিশ। দিনরাত গবেষণাগারে পড়ে থেকে ইন্ট্রাভেনাস রিহাইড্রেশন থেরাপির সহজ পথ খুঁজছিলেন তিনি। অবশেষে উপায় মিলল। হাতের কাছে থাকা দুটি চেনা উপাদান, নুন আর চিনি যথাযথ অনুপাতে জলে মিশিয়ে যে মিরাকল ঘটিয়ে দেওয়া যায়, বনগাঁ বর্ডারে তা প্রমাণ করে দিলেন ডঃ মহলানবিশ। তাঁর আবিষ্কৃত এই ওরাল স্যালাইনকে পরবর্তী কালে বলা হয়েছে বিশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার।
আরও শুনুন: কলকাতার রসগোল্লার জন্ম এঁর হাতেই, কীভাবে এল এই সাধের মিষ্টি?
একই সময়ে, একই কারণে এই পদ্ধতি বেছে নিয়েছিলেন ওপার বাংলার চিকিৎসক রফিকুল ইসলামও। পাকিস্তান-সিয়েটো কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরির গবেষক রফিকুল নিজেই যোগ দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। এই ল্যাবেই ডেভিড নেলিন এবং ক্যাস নামে দুজন ইউরোপীয় বিজ্ঞানীর সঙ্গে পরীক্ষানিরীক্ষা করে তিনিও তৈরি করেন পরিমিত ওরাল স্যালাইন।
তবে ORS-এর বিপুল ব্যবহারের পরেও তার স্বীকৃতি আসেনি সহজে। এমনকি একে ভারতের ব্ল্যাক ম্যাজিকের কোনও আচার বলেও দাগিয়ে দিয়েছিলেন কেউ কেউ। এইসব অপপ্রচারের সামনে রুখে দাঁড়ান আরেক বাঙালি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে জড়িত এই বিজ্ঞানী, ধীমান বড়ুয়া, ছিলেন দিলীপ মহলানবিশ-এর শিক্ষক। সেই সূত্রে ORS-এর কার্যকারিতার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন তিনি। ১৯৭৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধীনে ডায়রিয়া গবেষণা সংস্থা গড়ে তোলেন ডঃ ধীমান বড়ুয়া। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় ১৯৮০ সালে ওআরএস-কে স্বীকৃতি দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। রাষ্ট্রসংঘের উদ্বাস্তু শিবিরগুলিতেও ব্যবহৃত হতে থাকে এই প্রাণদায়ী সলিউশন। সমীক্ষা জানায়, যেখানে নয়ের দশকে বিশ্বে প্রায় ১২০ লক্ষ লোকের মৃত্যু হত ডায়রিয়ার কারণে, ২০১০ সালে সেই সংখ্যাটা নেমে এসেছে ১০ লক্ষেরও নিচে। আর এর সব কৃতিত্বই প্রাপ্য তিন বাঙালি- দিলীপ মহলানবিশ, রফিকুল ইসলাম এবং ধীমান বড়ুয়া-র।