ওদের ছিল শক্ত সমর্থ বেশিবহুল চেহারা, ইয়া বড় গোঁফ, কপালে লাল তিলক, হাতে থাকত বল্লম বা লাঠি। বাংলার সেইসব ডাকাতদের কথা মনে করলে আজও শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। অধিকাংশ ডাকতই কালীপুজো করত। নরবলিও দিত। আসুন শুনে নিই সেইসব ডাকাত কালীর গল্প।
গৃহস্থকে চিঠি লিখে আসত যে ডাকাতের দল, তারা মা কালীর সামনে নরবলিও দিত। বাংলার দুধর্ষ ডাকাতদের সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে কালীপুজো। ডাকাতদের মধ্যে অনেকেই নাকি ছিল মা কালীর ভক্ত। নিয়মিত পুজো দিত তারা। মধ্য রাতে পুজো দিয়ে বের হত ডাকাতি করতে। আবার ডাকাতি করে ফিরে এসে লুঠ করা সামগ্রী অর্পণ করত মায়ের চরণে। ডাকাতদের পূজিতা সেইসব কালীই লোকমুখে হয়ে গেল ডাকাত কালী।
সিঙ্গুরের পুরুষোত্তমপুরের ডাকাতকালীর কথা অনেকরই জানা। কারও কারও মতে, রঘু ডাকাত এই কালীপুজোর প্রতিষ্ঠাতা। অনেকে মনে করেন, গগন ডাকাত অর্থাৎ কিনা বিশু সর্দারের হাতেই শুরু হয় এই কালীপুজোর। বাংলার এমন বহু কালীমন্দিরের সঙ্গেই জড়িয়ে গেছে ডাকাতদের নাম। হুগলির ত্রিবেণীর ডাকাতকালী মন্দির তার মধ্যে অন্যতম। শোনা যায়, রঘু, বিশের মতো ভয়ঙ্কর সব ডাকাতেররা ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে এই মন্দিরেই পুজো দিত। এই মন্দিরটি নিয়ে রয়েছে আরও এক মিথ। কথিত আছে, একবার সাধক রামপ্রসাদকে বলি দেওয়ার জন্যে ধরে আনা হয়েছিল এই কালী মন্দিরে। বলি দেওয়ার আগে গান ধরেন রামপ্রসাদ। সেই গান শুনে ঘুমিয়ে পড়ে ডাকাতেরা।
আরও শুনুন: কালীপুজো মানেই ছিল ‘বুড়িমার চকলেট বোম’, কে এই বুড়িমা?
আউশগ্রামের পাণ্ডুক গ্রামে বামা কালীর প্রতিষ্ঠা করেন ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদ। সাড়ে তিনশ বছর আগের কথা। পাণ্ডুক গ্রামের মেটে পরিবারই নাকি প্রহ্লাদ ডাকাতের আজকেরে প্রজন্ম। এখানে কার্তিক মাসের অমাবস্যায় ২২ ফুটের দেবীর পুজো হয়। আউশগ্রামেরই বননব গ্রামের মেটে পাড়াতে রয়েছে আরও একটি ডাকাতকালী মন্দির। এই কালীকে পাণ্ডুকের বামা কালীর বোন মনে করা হয়। এককালে হুগলির কেলেগড়ের ডাকাতকালী মন্দিরের নাম শুনলেও ভয় পেত মানুষ। তখন অবশ্য কেলেগড়ের নাম অন্য কিছু ছিল। পরে এলাকার জমিদার কালাচাঁদের নাম থেকে হয় কেলেগড়। কালাচাঁদ ছিল কালীসাধক। সকালে ধার্মিক, সূর্য ডুবলে ভয়ঙ্কর ডাকাত! শোনা যায়, লুঠপাটের পাশাপাশি অনেককে ধরে বন্দি করে রাখত কালাচাঁদ। ওই বন্দিদেরই মা কালীর সামনে বলি দিত।
আরও শুনুন: বিলেতে মৃত্যু বড়লাটের, তবে কীসের টানে আজও নেটিভ শহরে ঘোরে হেস্টিংসের ভূত?
বাংলার এইসব কুখ্যাত ডাকাতদের মন বদলের কাহিনিও কিন্তু আছে। যেমন, সেবার কামারপুকুর থেক দক্ষিণেশ্বরে ফিরছিলেন সারদাদেবী। পথে পড়েছিল তেলোভোলের মাঠ। সঙ্গে অন্যরাও থাকলেও সারদাদেবী খানিক পিছিয়ে পড়েন। এবং ডাকত দলের পাল্লায় পড়েন। কিন্তু ডাকাত সর্দারের কাছে নিজেকে তার মেয়ে বলে পরিচয় দেন সারদাদেবী। এই কথা শুনেই সর্দারের মন গলে যায়। রাতটুকু পরম যত্নে সারদাদেবীকে নিজের বাড়িতে রাখেন সর্দার। সকালে নিজেই পৌঁছে দেন গন্তব্যে। পরবর্তীকালে এই তেলোভোলের মাঠেই মেয়ে রূপে সারদা মা-কে প্রতিষ্ঠা করে সর্দার। এখনও সেখানে পূজিতা হন সারদাদেবী।