আপনি যদি বাঙালি হন, ভাতের পাতে নিশ্চয়ই আপনার রোজ দেখা হয় ডালের সঙ্গে। সাদামাটা খাবার বোঝাতে চাইলে আমরা দুটো ডালভাতের কথা বলে থাকি। কিন্তু ডাল কি বাংলার নিজস্ব খাবার? কয়েকশো বছর আগে বাঙালি কি ডাল খেত?
সারাদিন পর বাড়ি ফিরেছেন? খুব ক্লান্ত? কোনোমতে নাকে মুখে দুটো ডাল-ভাত গুঁজে বিছানায় কাত। সকালে বেরোনোর সময়ও একই মেনুর পুনরাবৃত্তি। এ তো গেল রোজকার কথা। আবার কোনও বাঙালি অনুষ্ঠানে নেমন্তন্ন, বা কোনও এথনিক রেস্তরাঁয় বেঙ্গলি প্ল্যাটার, যা-ই বলুন, সেখানেও এই বস্তুটি অপরিহার্য। লুচির সঙ্গে ছোলার ডাল, মাছের মাথা দিয়ে সোনামুগ ডাল, কিংবা আজকের ‘ইন থিং’ বা খুব চালু ভেজ ডাল, ডালের দেখা আপনি পাবেনই।
কিন্তু বাঙালি বাড়ির প্রতিদিনের এই পদটি কি নিজে আদৌ বাঙালি? তাহলে বাঙালির খাবারের তালিকায় সে হান্ড্রেড পারসেন্ট অ্যাটেন্ডেন্স পায় কী করে?
আসলে মাছে-ভাতে বাঙালির যখন পকেটে পড়ল টান, তখন প্রোটিনের খোঁজে বেরোল সে। আর মাছের জায়গায় বসাল ডাল নামের খাবারটিকে। ডালে প্রোটিনের পরিমাণ শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ, তা ছাড়া এতে রয়েছে অনেকটা লাইসিন, আর মাছ-মাংসের চেয়ে দামেও সস্তা, তাই আপনি একে গরিবের আমিষ বলতেই পারেন। কিন্তু বাঙালির পুরনো খাদ্যতালিকায় ডালের খোঁজ পাবেন না। বাঙালির ইতিহাসকার নীহাররঞ্জন রায় বলছেন, ডালের চাষ এবং ডাল খাওয়ার রীতি, দুই-ই আর্য ভারতের দান। বাংলা, আসাম বা ওড়িশায় এখন যতরকমের ডাল খাওয়া হয়, তার কোনোটাই এখানে জন্মাত না। উত্তর ভারত থেকেই আমদানি হয়েছে এদের। ‘ডাল পাঁচমেল’ বা ‘পঞ্চরত্ন ডাল’ বলুন, ‘ডাল-বাটি-চুরমা’ কি ‘তরকা ডাল’, ভারতের এই অংশে ডালের ছড়াছড়ি। ভারতীয় আয়ুর্বেদের জনক চরক তাঁর বইয়ে কতরকম ডালের কথা বলেছেন জানেন? বারো রকম! প্রত্যেকটি ডালের আবার শাখাপ্রশাখা আছে। যেমন ধরুন, মুগডাল সাত রকমের। অড়হর তিন রকমের। সেরকমই রকমফের রয়েছে ডাল রান্নার ক্ষেত্রেও। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে ডালের বিভিন্ন পদের কথা তো আপনারা জানেন। কিন্তু জানেন কি, বাংলায় যে ছ-সাত রকম ডাল পাওয়া যায়, সেগুলো নিয়েই ৭৭ রকম রেসিপি লিখে গেছেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী! আর রেণুকা দেবী চৌধুরানীর বইতে পাওয়া যায় ডাল রান্নার ৭৩ রকমের পদ্ধতি। বোঝাই যাচ্ছে, ডাল বিষয়টা খুব একটা হেলাফেলার নয়। এমনকি নবাব বাহাদুরেরাও জড়িয়েছিলেন ডালের মোহে। বিশেষ করে হায়দরাবাদ আর লখনউয়ের নবাবরা। নিজামের বাবুর্চি পির আলি তো অড়হর ডাল রান্নার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। নবাব আসফ উদ-দৌলা পাঁচশ টাকা মাসমাইনেতে এক রাঁধুনিকে বহাল করেছিলেন, যার কাজ ছিল শুধু ডাল রান্না করা। কাজে যোগ দেওয়ার আগে সে শর্ত দিয়েছিল, নবাবের ডাল খাওয়ার ইচ্ছে হলে জানাতে হবে আগের দিন, আর ডাল তৈরি হয়েছে খবর পেলেই যেন তিনি খেতে বসেন। একদিন এই নিয়মেই ডাল তৈরি হল। কিন্তু নবাব তখন ভারী ব্যস্ত। অবশেষে তিনি যখন এসে হাজির হলেন, রাঁধুনি তক্ষুনি সমস্ত রান্না ডাল ঢেলে দিল একটা শুকনো গাছের গোড়ায়, আর কাজে দিল ইস্তফা।
তাহলেই বুঝুন, এহেন ডালের হালচাল সামলানো কি আপনার আমার মতো ছা-পোষা বাঙালির কম্ম?