সরস্বতী বিদ্যার দেবী। কিন্তু ‘সরস’ অর্থাৎ জলের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সংযোগ। তাই এককালে কৃষিদেবীর মর্যাদাও পেতেন দেবী সরস্বতী। সরস্বতী পুজোর পরের দিনের আচার হয়তো ধরে রেখেছে সেই পরম্পরাকেই। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
সরস্বতী নদীই নাকি ছিল বৈদিক সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র। নদীর দুধারে গড়ে উঠেছিল যে সভ্যতা, তারা শস্য উৎপাদনের জন্য নির্ভর করত এই নদীর উপরেই। অন্নদাত্রী বলে পুজোও করত সরস্বতী নদীকে। ক্রমশ সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠল তার নিজস্ব সংস্কৃতি। রচিত হল সাহিত্য। সেইসব সাহিত্যিক নিদর্শনের সঙ্গেও জুড়ে গেল সরস্বতীর বন্দনা। কৃষিদেবী পরিণত হলেন বাক্দেবীতে। কিন্তু আজও বাংলার ঘরে ঘরে সরস্বতী পূজার পরের দিন যে আচারটি পালিত হয়, সেখানে ইঙ্গিত মেলে সেই অতীত ইতিহাসের।
আরও শুনুন – SPECIAL PODCAST: উড়ো চিঠির হাতছানি আর স্মৃতির কোলাজে ডুব, বাঙালির বাণীবন্দনা
প্রাচীন যুগেও নাকি ফসল ভাল হওয়ার কামনায় ব্রত করতেন সরস্বতী নদীতীরের সেই কৃষকরমণীরা। তাকে বলা হত ‘সারস্বত ব্রত’। আর এখনও সরস্বতী পুজোর পরের দিন পালিত হয় শীতল ষষ্ঠী। একান্তই মেয়েদের ঘরোয়া ব্রত। লৌকিকও। ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’, বাঙালি ঘরের সেই চিরন্তন মঙ্গলকামনাই লগ্ন হয়ে আছে এই লোকাচারের সঙ্গে। এই আচারের সঙ্গে কোনও মন্ত্র-তন্ত্রের আড়ম্বর জড়িয়ে নেই, বরং এর গায়ে যেন লেগে আছে সেই প্রাচীন মাটির গন্ধ। শস্যই এই ব্রতের মূল উপকরণ। এই দিন রান্না করার নিয়ম নেই। নিয়ম নেই শিল পাতারও, অর্থাৎ মশলা পেষাও বন্ধ পরোক্ষভাবে। আসলে বাড়ির শিল ও নোড়াকে এদিন পুজো করা হয়। আর ব্রতের পারণ হয় গোটা সেদ্ধ খেয়ে।
কী এই গোটা সেদ্ধ?
আরও শুনুন – তিনি দেবী, আবার নদীও… এককালে কৃষির দেবী হিসেবেও পূজা পেতেন সরস্বতী
আসলে সবকিছু গোটা অর্থাৎ আস্ত হিসেবেই সেদ্ধ করা হয় বলে এমন নাম। গোটা সেদ্ধ তৈরির জন্য দরকার হয় জোড়া শস্য। ৬টি করে নতুন আলু, রাঙা আলু, বেগুন, শিষ পালং, শিম, মটরশুঁটি। বুঝতে অসুবিধা হয় না, শীতের নতুন শস্যগুলিই রয়েছে এই তালিকায়। যেন নবান্নের মতোই, নতুন শস্য দেবতাকে উৎসর্গ করার রেওয়াজ। এই শাকসবজিগুলি ছাড়াও দরকার হয় সবুজ মুগ, সরষের তেল, আর যেটুকু মশলা রান্নায় পড়ে তাও গোটাই থাকে, অর্থাৎ বাটা হয় না। গোটা সেদ্ধ তৈরির সময় কোনও সবজি কাটা যায় না। এমনকি ছাড়ানো হয় না আলুর খোসাও। সঙ্গে থাকে আগের দিনের রান্না করা পান্তা ভাত।
এই সময়ে, যখন কৃষি আর আমাদের একমাত্র জীবিকা নয়, তখনও টিকে রয়েছে এই প্রথা। যেন ধরে আছে প্রাচীন কৃষিজীবী বাংলার শিকড়কেই।