বাংলার খুব চেনা এক বাগধারা হল ‘মগের মুলুক’। কী মানে এই কথার? কোথা থেকেই বা উৎপত্তি হল এই কথার? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
‘মুলুক’ শব্দের অর্থ যে ‘জায়গা’, সে তো সবাই জানি। কিন্তু ‘মগের মুলুক’ জায়গাটা ঠিক কোথায়, সে কথা কি জানেন? অথচ আজও কোনও জায়গায় অশান্ত অরাজক পরিস্থিতি দেখা দিলে তা ‘মগের মুলুক’ আখ্যা পেয়ে যায় সহজেই। কী অর্থ লুকিয়ে আছে এই ‘মগ’ শব্দের আড়ালে? তা জানার জন্য পায়ে পায়ে পিছিয়ে যেতে হবে কয়েকশো বছর।
আরও শুনুন: কথায় বলে ‘চালাও পানসি বেলঘরিয়া’… কেন নৌকা চড়ে বেলঘরিয়াতেই যেতেন সেকালের মানুষ?
সেটা ষোড়শ শতক। ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে বাংলার গাঁ-গঞ্জ। কোথা থেকে যে উদয় হয়েছে একদল ভিনদেশি দস্যু! টকটকে গায়ের রং, বিরাট চেহারা, কটা চুলদাড়ির জঙ্গল, দেখলেই পিলে চমকে যায়। তার উপর তাদের কোমরে বাঁধা লম্বা তরোয়াল। কোনোরকম জানান না দিয়েই হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। লুঠপাট তো চালায়ই, তার চেয়েও ভয়ংকর কথা হল, মেয়ে-মদ্দ সবাইকে ধরেবেঁধে সঙ্গে নিয়ে যায় এই দস্যুরা। মেয়েদের উপর অত্যাচার করা তো সব লুঠেরারই ধর্ম, কিন্তু জোয়ান মরদদের নিয়ে এরা যে কী করে কে জানে!
সেদিন বাংলার গাঁয়ের মানুষ যা জানত না, পরবর্তীকালে তার উত্তর দিয়েছেন ইতিহাসবিদেরা। জানিয়েছেন, মানুষ কেনাবেচার ব্যবসা ছিল ওই দস্যুদের। জাতিতে তারা পর্তুগিজ। মানুষ যা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারে না, তেমন অত্যাচারই করত তারা ওই ধরে আনা বন্দিদের সঙ্গে। জাহাজের খোলে গাদাগাদি করে মানুষ পাঠাত এক দেশ থেকে আরেক দেশে। তারপর খোলা হাটে ক্রীতদাস কেনা বেচা।
আরও শুনুন: শেষপাতে বাঙালির প্রিয় যে দই, তা কি জন্মসূত্রে ‘বাঙালি’?
গোটা মুঘল আমল, এমনকি ব্রিটিশ রাজত্বের শুরুতেও ভারতের সমুদ্র-উপকূলে এমন যখনতখন হানা দিয়ে লুঠপাট চালাত পর্তুগিজরা। সুলতান হুসেন শাহের আমলে বাংলার পূর্ব আর দক্ষিণ সীমান্তে এসে হাজির হয় পর্তুগিজদের অজেয় নৌবহর। ‘নৌবহর’-এর প্রতিশব্দ ‘আর্মাডা’ কথাটি স্থানীয় লোকের মুখে অপভ্রংশ হয়ে পরিণত হয় ‘হার্মাদ’-এ। বাণিজ্যের প্রয়োজনে পর্তুগিজরা বাংলার যেসব অঞ্চলে ডেরা বেঁধেছিল, তাদের মধ্যে ছিল চট্টগ্রাম বন্দর। সেখানকার বেপরোয়া মগদের সঙ্গে ক্রমে হাত মেলায় তারা, আর উভয় দলের মিলিত আক্রমণ প্রতিরোধ করা কারও পক্ষেই কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এদের দাপটে বাংলায় একরকম অরাজক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল বললেও ভুল হবে না। বাঙালি নামের আগে যেভাবে ‘শ্রী’ লেখা হয়, তেমনভাবেই নামের আগে ‘মং’ লেখার চল ছিল চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এই ‘মং’ শব্দই লোকের মুখে মুখে পালটে গিয়েছিল ‘মগ’-এ। আর মগ হানাদারদের বাসস্থানকেই ‘মগের মুলুক’ বলে ডাকতে শুরু করে বাংলার মানুষ।