বিদ্রোহী কবির গানের আত্মা নষ্ট হয়েছে এ আর রহমানের হাতে। ‘কারার ঐ লৌহকপাট’-এর সাম্প্রতিক সুর শুনে রীতিমতো ক্ষুব্ধ বাঙালিরা। অনেকেই বলছেন, গানের মানে বুঝলে এমন ভুল করতেন না তিনি। স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী কিন্তু অনুবাদেই বুঝেছিলেন নজরুলের গানের কথার অর্থ।
কাজী নজরুল ইসলামের গান শুনে মুগ্ধ মহাত্মা গান্ধী। শুনছেন অপূর্ব সঙ্গীত। তবে, ভাষার কারণে অনেকটাই যেন অধরা থেকে যাচ্ছে। গানের অর্থ যাতে তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারেন সেই কারণেই ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছিল বিদ্রোহী কবির ‘চরকার গান’।
সম্প্রতি সেই অর্থের গোলমালেই নতুন করে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ যেভাবে সুরারোপিত হয়েছে, এ আর রহমানের হাতে, তাতে বাঙালির অন্দরমহলে বিতর্ক তুঙ্গে। বিদ্রোহী কবির গান না বুঝেই সুরারোপ করেছেন বলে যে অভিযোগ বাঙালিরা তুলেছে, তা সত্যি। যে প্রেক্ষিতে এই গান রচিত হয়েছিল, গানের সুরে-ছন্দে যে ভাব, তা কোনও ভাবেই ফুটে ওঠেনি রহমানের সুরে। কেউ কেউ তাই তাঁর কঠোর সমালোচনা করেছেন। কেউ কেউ আবার খানিক নরম হয়ে বলছেন, গানের কথার অর্থ না বোঝার ফলেই সুরের এই পরিণতি। এ বিতর্কের জল ক্রমশ গড়াচ্ছে। হয়তো এগোবে আইনি পথেও। তবে সেবার শুধু এই অর্থ স্পষ্ট করার জন্যই অনূদিত হয়েছিল কাজীসাহেবের গান।
আরও শুনুন: স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সঙ্গীতের এই পরিণতি! রহমানিয়া লৌহকপাট কি তাড়াহুড়োর ফসল?
সে সময় হুগলিতে এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। কাজী নজরুল ইসলামও সেখানেই বসবাস করছিলেন। একটি সভার আয়োজন হয়েছিল, যেখানে উদ্বোধনী গান করেছিলেন স্বয়ং কাজীসাহেব। সেটি ছাড়াও, সেই দিন দুয়েকের অবসরে সেবার পরপর বেশ কয়েকটি গান মহাত্মাজিকে শুনিয়েছিলেন তিনি। প্রত্যাশিত ভাবেই তাঁর গানে মুগ্ধ হন গান্ধী। এই তালিকাতেই ছিল নজরুলের বিখ্যাত সেই ‘চরকার গান’। গানটি খুবই ভালো লেগেছিল গান্ধীজির। কিন্তু বাংলা ভাষা তিনি সেভাবে বুঝতেন না। তাঁর সুবিধার্থে কবি সুবোধ রায় গানটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। গানের ছন্দ ও সুর বজায় রেখেই। এই সেই বিখ্যাত গান যেখানে কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন- ‘ঘোর-.ঘোরে ঘোর ঘোররে আমার সাধের চরকা ঘোর । ঐ স্বরাজ-রথের আগমনী শুনি চাকার শব্দে তোর’। … ইংরেজি অনুবাদে যখন এ গানের অর্থ স্পষ্ট হল মহাত্মাজির কাছে, তিনি মুগ্ধ হলেন। তাঁর দর্শনই যেন এ গানের ভিতর সুরে-ছন্দে ধ্বনিত হয়েছে। এতটাই আবিষ্ট হয়েছিলেন তিনি এই গানে যে, তিনি অনুবাদককে একটি চিঠি লেখেন এবং সেখানে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন কাজী নজরুল ইসলামের। ভাষান্তরিত হয়েছিল বলেই সেদিন বিদ্রোহী কবির গানের আত্মাটি ধরা দিয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর কাছে। সুধীরকুমার মিত্র তাঁর ‘পত্র ও পত্রিকার আলোকে নজরুল’ বইটিতে এই প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছেন।
কাজীসাহেবের গান ভারি প্রিয় ছিল সুভাষচন্দ্র বসুরও। ১৯২৯ সালে কাজী নজরুল ইসলামকে অ্যালবার্ট হলে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সে সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। উপস্থিত ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুও। সেই সভাতেই সুভাষ জানিয়েছিলেন, ‘কাজীর লেখার প্রভাব অসাধারণ। তাঁর গান পড়ে আমার মতো বেরসিকেরও জেলে বসে গান গাইবার ইচ্ছা হয়। আমাদের প্রাণ নেই, তাই আমরা এমন প্রাণময় করিয়া লিখতে পারি না।’ সুভাষের মতো দেশপ্রেমিক নজরুলের গানে যে প্রাণের সন্ধান পেয়েছিলেন, সেই প্রাণটিরই যেন বড় অভাব কারার ঐ লোহকপাটের রহমানিয়া সুরে। আর তাই নিয়েই যত অভিযোগ।