খিচুড়ি। নামে সাধারণ, কিন্তু স্বাদে অসামান্য। গড়পড়তা বাঙালির পাত থেকে সেকালের রাজা মহারাজাদের ভোজের আসর, খিচুড়ি সর্বত্র উপস্থিত। চমকে গেলেন! কোন রাজা-বাদশা মজেছিলেন খিচুড়ির প্রেমে? তাহলে সেই গল্পই শুনুন।
বাঙালির কাছে বৃষ্টির দিনের পাত হোক কি পুজোর ভোগ, খিচুড়ি তাতে থাকবেই। আর শুধুমাত্র বাংলাই নয়, সারা ভারতেই খিচুড়ি নানা চেহারায়, নানা নামে আদর পেয়ে আসছে। কখনও সে গরিব মানুষের অনাড়ম্বর খাদ্য, কখনও রোগীর পথ্য, কখনও বিভিন্ন উপকরণে সাজানো দেবভোগ্য পদ। কিন্তু খিচুড়ির ভক্ত কি কেবল আমজনতাই? নাকি রাজা-বাদশারাও এর কদর করেছিলেন একইভাবে?
এ কথা ঠিক, খিচুড়ি আদতে ছিল সাধারণ মানুষের খাবার। এখনও চটজলদি খাবার বানাতে হলে চালে ডালে বসিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়। বানাতে এত সুবিধা বলেই খিচুড়ি খেটে খাওয়া মানুষের প্রিয় খাদ্যও। এমনকী, সাগরপারে ‘কেডজ্রি’ বলে যে খাবারটি প্রাতরাশের টেবিলে হাজির করা হয়, তাও আসলে আমাদের খিচুড়ি-ই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যেসব অফিসারেরা দেশে ফিরে গিয়েছিলেন, তাঁদের হাত ধরেই বিলেতে খিচুড়ির পদার্পণ। আগের রাতের যে ডাল আর ভাত বেঁচে যেত, তা দিয়েই এই খাবারটি তৈরি হত। স্কটরা অবশ্য দাবি করতে চেয়েছিলেন যে খিচুড়ি তাঁদের নিজস্ব খাবার, তাঁদের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গেই তা ভারতবর্ষে এসেছিল আর এখান থেকে ইংরেজদের সঙ্গে তা পৌঁছে গেছে ইংল্যান্ডে, কিন্তু সে দাবি ধোপে টেকেনি।
তাহলেই বুঝুন, আপনি যে খিচুড়িকে খুব চেনা সাধারণ পদ বলে ভেবে আসছেন, তার মালিকানা নিয়েই কিনা দেশে বিদেশে টানাটানি! তবে আপনার আর দোষ কোথায়! আপনার কাছে তো আর খিচুড়ি কোনও দুর্মূল্য বা দুষ্প্রাপ্য খাবার নয়। বৃষ্টি নামলেই তো আপনার মনটা খিচুড়ি খিচুড়ি করে ওঠে। আবার বর্ষাকাল পেরিয়ে শরৎ এল মানেই পুজোর ভোগের মরশুম। মা দুর্গা হোন কি তাঁর মেয়েরা, তাঁদের সামনে বড় বড় কানাউঁচু পরাতে বেড়ে দেওয়া হয় ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি। চাল-ডালের ভিড় থেকে মুখ বের করে থাকে নারকেলকোরা, বাদাম, মটরশুঁটিরা। ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে আবার ছবিটা উলটো। এখানে দেবী পার্বতীর ভাগ্যে খিচুড়ি ভোগ জোটেনি, বরং তাঁকেই ফরমাশ করা হচ্ছে খিচুড়ি রাঁধবার জন্য। তা আবার যেমন তেমন খিচুড়ি নয়। কখনও মুগডালের খিচুড়িতে দেওয়া হচ্ছে ডাবের জল, তো কখনও আদা আর কাসুন্দি হচ্ছে খিচুড়ির উপকরণ। আর নির্দেশ দিচ্ছেন কে? কে আবার? স্বয়ং শিব ঠাকুর! কেবল দুর্গা-লক্ষ্মী-সরস্বতী ঠাকুরই খিচুড়ির ভক্ত নন কিন্তু। পুরীতে জগন্নাথদেবের মন্দিরে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ মন চালের খিচুড়ি রান্না হয়। ‘জগাখিচুড়ি’ শব্দটার মানে যদিও গোলমাল পাকানো, কিন্তু জগন্নাথের প্রসাদ থেকেই এ শব্দের উৎপত্তি।
আরও পড়ুন: ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল, চক্রান্তের স্বীকার হয়েছিলেন দেশের প্রথম মহিলা ডাক্তার Kadambini Ganguly!
দেবতারা যা খান, সম্রাটরা তা খাবেন না, তাও কি হয়? আকবরের আত্মজীবনীতে সাত রকম খিচুড়ির রেসিপি রয়েছে। সত্যি বলতে, মুঘল আমলে খিচুড়ি যে এত জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, তার পিছনে রয়েছে বাদশাদের পৃষ্ঠপোষকতা। সম্রাট জাহাঙ্গীর গুজরাটে ভুট্টার খিচুড়ি খেয়ে এত খুশি হয়েছিলেন যে, তক্ষুনি মুঘলাই হেঁশেলে সে খিচুড়ির আসন পাকা হয়ে যায়। আবার হুমায়ুন যখন শের শাহ-র তাড়া খেয়ে পারস্যে পৌঁছন, সেখানকার শাহকে তিনি নেমন্তন্ন করেন। ভোজের মেনুতে ছিল ভারতীয় খিচুড়ি। সেই রাজসিক খিচুড়ি খেয়ে শাহ তো একেবারে মুগ্ধ। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মনস্থির করে ফেললেন, হুমায়ুনকে পারস্যে আশ্রয় দেওয়া যাক।
এমনই এক ভোজের আয়োজন করেছিলেন শাহজাহানও। পর্তুগিজ পর্যটক সেবাস্টিয়ান মানরিখের সম্মানে ছিল সেই ভোজ। আর তাঁকে খাওয়ানো হয়েছিল পেস্তা বাদাম আর গরম মশলা দেওয়া খিচুড়ি। সাহেব পরে বলেছেন, তাঁর মনে হচ্ছিল তিনি মণিমাণিক্যের খিচুড়ি খাচ্ছেন।
বুঝতেই পারছেন, খিচুড়ির প্রতি প্রেম কেবল আমার আপনার নয়, রাজা বাদশাদেরও কম ছিল না। সেইজন্যই তাঁদের সঙ্গে জুড়ে থাকা গল্পকথাতেও খিচুড়ি রয়েছে বহাল তবিয়তে। কোনও গল্পে খিচুড়ি রান্না করে আকবরকে নীতিশিক্ষা দিচ্ছেন বীরবল। আবার কোনও গল্পে রয়েছেন রাজস্থানের রানা-রা। মেবারের রানা কুম্ভ তখন চিতোর দখল করে নিয়েছেন। পরাজিত, সর্বস্বান্ত রাও যোধা পরিচয় লুকিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন এক চাষার বাড়িতে। পেটে দাউদাউ খিদে। চাষিবউ খিচুড়ি এনে দিতে না দিতেই যোধা হাত দিলেন গরম খিচুড়িতে। যা হয়, আঙুল পুড়িয়ে ফেললেন সঙ্গে সঙ্গে। তখন চাষিবউ তাঁকে বলল, খিচুড়ির মাঝখানটা সবচেয়ে গরম থাকে আর ধারগুলো ঠান্ডা। তাই খাওয়া শুরু করতে হয় ধার থেকে। এই সামান্য কথাতেই যোধার টনক নড়ল। তিনি সরাসরি চিতোর আক্রমণের চেষ্টা ছেড়ে চারপাশের দুর্গগুলো জয় করতে লাগলেন। অবশেষে, পনেরো বছর পর রাজত্ব ফিরে পান তিনি।
আরও পড়ুন: jalebi: জিলিপি নাকি ভিনদেশি? অমৃতির বাড়িই বা কোথায়!
তাহলে, এক বাটি খিচুড়ির গুরুত্ব বুঝলেন তো! আপনি নাহয় ছা-পোষা বাঙালিই, কিন্তু খিচুড়ির সামনে বসলে নিজেকে আকবর বাদশা ভেবে নিতেই বা আপত্তি কোথায়!