তিনি আন্তর্জাতিক। আধুনিক। তিনি নিখাদ বাঙালিও। কোনোটির সঙ্গেই কোনোটির বিরোধ নেই। এই সত্য যিনি আধুনিক কালে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। যে আধুনিকতা ধর্মপরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্বমানবতার পরিচয় দেয়, সেই আধুনিক মননই নিজের যাপনে আর সৃষ্টিতে ধারণ করতেন সত্যজিৎ। তাঁর বাঙালিয়ানার ধারণাও তাই শিকড় স্পর্শ করেই ছুঁয়ে থাকে আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তি। বাঙালির অন্যতম আইকনের বাঙালিয়ানার এই সূত্রটিই শতবর্ষ পরেও তাই সকল বাঙালির কাছে হয়ে ওঠে অভিজ্ঞান-অঙ্গুরীয়। লিখলেন সরোজ দরবার।
সত্যজিৎ রায়- আধুনিক বাঙালি মননের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়। শুধু চলচ্চিত্রের ভাষাতেই যে তাঁর আধুনিকতার আরাধনা, তা নয়। সত্যজিতের আধুনিকতা এক দিগন্তব্যাপী আকাশ। সেখানে জায়গা নেই কোনওরকম সংকীর্ণতার। বরং নিজস্ব সংস্কৃতির সূত্রে যে আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছানো যায়, সত্যজিতের সৃজনের পথের পাঁচালি বাঁধা সেই সুরেই। সিনেমার ভাষা সর্বজনীন, স্বতন্ত্র। তবু এ কথা তো অনস্বীকার্য যে, বাংলা ভাষাতেই তাঁর চলচ্চিত্র রচনা করেছেন সত্যজিৎ। খুঁজে দেখেছেন বাঙালি স্মৃতি, সত্তা, ভবিষ্যৎ। তাঁর আজীবনের কাজ বাংলা ভাষা এবং বাঙালিকে ঘিরেই। অথচ কে না জানে, তাঁর সৃজন স্পর্শ করেছে আন্তর্জাতিকতার শীর্ষবিন্দুও। ঠিক এইখানেই অনন্য হয়ে ওঠেন সত্যজিৎ। যেন হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথের সার্থক উত্তরসূরি। তাঁর বাঙালিয়ানা তাই এমন এক বিশেষ ধারণা, যার প্রকাশ কেবল পোশাকে-আশাকে বা বিশেষ কতকগুলো চিহ্নধারণে নয়। কেবল নির্দিষ্ট কিছু উৎসব পালন বা কবিতা-গানের পঙক্তি আওড়ানোয় নয়। সত্যজিতের বাঙালিয়ানা আসলে সমস্ত সংকীর্ণতার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে থাকা বিশেষ এক যাপন-ধর্ম।
আরও শুনুন:
দুর্ভাগা সে দেশ… সম্প্রীতির প্রয়োজনে শিল্পীর বন্ধুতাও যেখানে মাপা হয় ধর্মের পরিচয়ে
এই যে ধর্মের কথা এসে গেল, এই ধর্ম অবশ্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নয়। আগন্তুক-এর মনমোহন মিত্রকে মনে আছে? যাঁর মুখ দিয়ে সত্যজিৎ যেন নিজের জীবনদর্শনকেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন। সেই মনমোহন বলেছিলেন, “যে জিনিস মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, আমি তাকে মানি না।” ধর্মের এই প্রাতিষ্ঠানিকতায় সত্যজিৎ কি নিজে বিশ্বাস করতেন? উত্তরে নাই-ই বলতে হয়। প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক লেখক অমিত চৌধুরী সত্যজিৎ স্মরণে তাঁর এক বক্তৃতায় একটি প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছিলেন। কোনও এক বিখ্যাত পত্রিকার তরফে সত্যজিৎকে একদা জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি কি হিন্দু? উত্তরে সত্যজিৎ জানিয়েছিলেন, তিনি বাঙালি। অর্থাৎ ধর্ম-পরিচয় যে তাঁর কাছে প্রধান ছিল না, তা খোলসা করে দিয়েছিলেন তিনি। ধর্মের যে বিপদের কথা মনমোহন মিত্রের সংলাপে তুলে এনেছিলেন, বা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের যে বিষময় রূপ তিনি গণশত্রুতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তার উপর তাঁর যে তেমন বিশ্বাস থাকবে না, সেটাই স্বাভাবিক। আসলে তো সত্যজিৎ বিশ্বমানবতারই পথিক। সেখানে প্রশ্রয় নেই বিভাজনের। জাতীয়তাবাদের উগ্রতা যে বিপদ ডেকে আনতে পারে, সেই ভাবনার বিন্দুতে তিনি মিলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই। ‘ঘরে-বাইরে’র চিত্রায়ণ নিঃসন্দেহেই তাঁর এই ভাবনার পরিচয় দেয়। তারও আগে ‘দেবী’-র ভিতরেও কি আমরা ধর্মের এই অচলায়তনের সন্ধান পাচ্ছি না! সত্যজিৎ যেন বাস্তবের সূত্র ধরেই এই বাস্তবতা অতিক্রমের পথের হদিশ দিচ্ছিলেন আমাদের। বিভেদ, বৈষম্য, গোঁড়ামির অচলায়তন ভাঙার সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর দর্শন নিহিত হয়ে আছে তাঁর সৃজনে। যে বাঁধ বেঁধে আমরা মুক্তধারা আটকে রাখি, সেই বাঁধ ভাঙার ডাক যেন রবীন্দ্রনাথের থেকে আহরণ করেই সত্যজিৎ সঞ্চারিত করেছিলেন সমকাল ও ভাবীকালের মননে। এমনকী ভাষাগত এলিটিজমকেও তিনি প্রশ্রয় দেন না। খেয়াল করে দেখুন, গুপীর সেই গান- “ভাষা এমন কথা বলে/ বোঝে রে সকলে/ উঁচা নিচা ছোট বড় সমান”। নানারকমের বৈষম্য যে ঘনিয়ে তোলে সভ্যতার সংকট, পূর্বসূরির সূত্রেই সে-কথা জানতেন সত্যজিৎ। সমকালকে তিনি যেভাবে দেখছিলেন, তার ক্ষয় অবক্ষয় নৈরাজ্যকে যেভাবে অনুবাদ করেছিলেন চলচ্চিত্রের আঙ্গিকে, সেই সূত্রেই বোধহয় সভ্যতার আধুনিক সংকটের স্বরূপ ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছিল তাঁর কাছে। আর তাই এর প্রতিরোধী যে দর্শন, সেই মানবধর্মের কথাই শেষ পর্যন্ত বলতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ। আগন্তুক-এর ছত্রে ছত্রে, মনমোহনের শাণিত বাক্য ও যুক্তি যখন আমাদের মেকি সভ্যতাকে প্রায় বেআব্রু করে তোলে, আমরা যেন বুঝতে পারি সত্যজিৎ কোন আধুনিকতা, কোন বাঙালিয়ানার কথা আমাদের ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তাঁর আজীবনের কাজে।
আরও শুনুন:
মতবিরোধ সত্ত্বেও সৌজন্য, সত্যজিৎ-মৃণাল সম্পর্ক দিশা দেখায় ‘দিকভ্রষ্ট’ বাঙালিকে
সভ্যতার সংকট তার রূপ বদলায়। বদলায় না মৌলিক প্রবণতাগুলি। তাই বর্তমান সময়ে আবার যেন ধর্মভিত্তিক পরিচয় গড়ে তোলে বিদ্বেষের নিগড়। হানাহানি, হিংসা এসে চাপা ফেলে দেয় মানবতার শাশ্বত সত্যগুলিকে। কিন্তু এই বাস্তবতাই চূড়ান্ত সত্য নয়। ভাবনার পৃথিবীতে এই অবলম্বনে পৌঁছাতে আজও আমাদের নিবিড় আশ্রয় হয়ে দাঁড়ান সত্যজিৎ। তাঁর সৃষ্টির সূত্রেই আমরা চিনে নিতে পারি স্রষ্টার দর্শনকে। যা জানায়, বিভাজন আর গোঁড়ামি নয়, বরং উদারতাই খুলে দেয় আধুনিকতার জানলা। আন্তর্জাতিক আকাশ তখন নেমে আসে এই বাংলার মাটিতেই। সেদিন সত্যজিৎ দ্বিধাহীন বলেছিলেন তিনি বাঙালি। তাঁর শতবর্ষে, তাঁর সৃষ্টির ভিতর নিহিত সত্যটুকু আজও আমাদের দ্বিধাহীন বলতে শেখায়, ধর্মপরিচয় নয়, বাঙালির শ্রেষ্ঠ পরিচয় যে সে বাঙালি। ঠিক এইখানেই আজও যেমন প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন সত্যজিৎ রায়, তেমনই প্রাসঙ্গিক থেকে যাবেন তিনি আগামী পৃথিবীতেও।