কথায় বলে সাধু সাবধান। যে কোনও মানুষের উদ্দেশেই এখন এ কথা বলা হয় বটে, কিন্তু আসলে কোন সাধুদের সাবধানে থাকতে বলা হয়েছিল এ কথায়? কেনই বা এহেন সাবধানবাণী? শুনে নেওয়া যাক।
ফেলুদার ‘নেপোলিয়নের চিঠি’ রহস্যে ছিল এক কথা বলা চন্দনা পাখি। যে কথায় কথায় বলত, ‘সাধু সাবধান’। আর পাখির কথা শুনেই সাধু নামের অসৎ লোকটির সন্দেহ হয়েছিল, বুঝি তাকেই হুঁশিয়ারি দেওয়া হচ্ছে। এ নাহয় গল্পকথা, তবে ‘সাধু সাবধান’ কথার প্রয়োগ কিন্তু চলে আসছে অনেকদিন ধরেই। কাউকে বিপদ থেকে সতর্ক করে দিতেই হোক, বা বাড়াবাড়ি না করে সামলে চলার হুঁশিয়ারি দিতেই হোক, এ কথা অনেকেই বলে থাকেন। কিন্তু সাধু বলতে আসলে কাদের বোঝায় এ কথা? কেনই বা সাবধানে থাকতে হয় তাঁদের?
আরও শুনুন:
সাহেব-বিবি-গোলাম টানা ঔপনিবেশিকতা নেই, একেবারে স্বতন্ত্র বাংলার দশাবতার তাস
‘সাধু’ শব্দ বললে এখন প্রথমেই তার যে অর্থ মাথায় আসবে, তা হল সন্ন্যাসী। বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করলে সাধু অর্থ সৎ, আর বিশেষ্য হলে এর প্রধান অর্থই সন্ন্যাসী। ধরেই নেওয়া হয় যে, যিনি লোভ-স্বার্থ-হিংসা জয় করে সন্ন্যাস নিয়েছেন, সততার সঙ্গে তাঁকেই সমার্থক বলে ধরা যায়। কিন্তু সেই সততা বা স্বার্থত্যাগকে গুরুত্ব দিয়ে সবসময় যে সাধুসন্ন্যাসীদের সম্মান করা হয়, তেমনটা কিন্তু নয়। প্রাচীন কালে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উপর একাধিক আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। মনে রাখা ভালো, সেই সময়ে রাজা ও ধনীদের অনুগ্রহে মঠ-মন্দিরে সম্পত্তি কম থাকত না। সম্প্রতিও রামকৃষ্ণ মিশনে ঢুকে সন্ন্যাসীদের উপর আক্রমণের ঘটনায় শোরগোল পড়েছে বাংলায়। এর নেপথ্যেও সম্পত্তি সংক্রান্ত গোলযোগ থাকার জল্পনা উঠেছে। সুতরাং, যখন সময়টাই অশান্ত, সেই সময় সাধুরাও যে নিরাপদ নন তা বুঝেই তাঁদের সাবধান করার চিন্তা আসতেই পারে।
তবে কথা হল, সাধু শব্দের কিন্তু আরও একটি অর্থ রয়েছে। শ্রেষ্ঠী বা ব্যবসায়ী। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘বেণের মেয়ে’ উপন্যাসে বারেবারেই সাধু সম্বোধন করেছেন। আবার শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘ’ উপন্যাসেও রাজবয়স্য অনঙ্গপাল ব্যবসায়ীর ছদ্মপরিচয়ে নাম নেয় মধুকর সাধু। ব্যবসায়ীদের পদবি হিসেবে সাধু বা সাধুখাঁ, কিংবা তার অপভ্রংশে সাহু বা সাহা বা সাউ সবই এখনও প্রচলিত। আর বণিক বা ব্যবসায়ীরাই তো বরাবর ধনসম্পত্তির একটা বিপুল অংশের মালিকানা হাতে রেখেছেন। ধন থাকলে তা চুরি হওয়ার ভয়ও থাকবেই। আগেকার দিনে স্থলপথে বা জলপথে বাণিজ্যের সময় বণিকদের উপর হামলার ঘটনা ঘটত প্রায়শই। সুতরাং তাঁদের যে সাবধানে থাকতে হবেই, সে কথা আর আশ্চর্যের কী!
আরও শুনুন:
পাপ, প্রায়শ্চিত্ত, উপবাস: ভোট যেন পঞ্জিকায় বাঁধা শাস্ত্রীয় ধর্মকর্ম
বোঝাই যাচ্ছে, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষই হতে পারেন এই সাবধানবাণীর লক্ষ্য। আর সেখান থেকেই এই প্রবাদের অর্থবিস্তার ঘটেছে আরও। যে-কোনও সৎ মানুষকে সাবধানে থাকতে বলার পরামর্শ হিসেবেও তা ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার যে সৎ বা সাধু প্রকৃতির নয়, তাকে সামলে চলতে বলার হুঁশিয়ারি দিয়েও কেউ বলতেই পারেন, ‘সাধু সাবধান!’